অভিমানী রানী

অভিমানী রানী

অনেক দিন আগে ছোট্ট সুন্দর এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্য শাসন করতেন এক রানী। রানী ছিলেন প্রজ্ঞাময়ী এবং দয়ালু। তাঁর শাসনে রাজ্যটি শান্তি ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠেছিল। প্রজারা সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করত, কারণ রানী তাদের কল্যাণের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। রাজ্যে কোনো অভাব ছিল না, চুরি-ডাকাতি বা গৃহহীনতার মতো সমস্যাও ছিল না। রানী তাঁর প্রজাদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন এবং তাদের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

অভিমানী রানী

কিন্তু কথায় বলে, সুখ বেশি দিন টেকে না। প্রজাদের জীবনে যখন শান্তি বিরাজ করছিল, ঠিক তখনই তাদের মধ্যে কিছু মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল। তারা রানীর সরলতা ও দয়াকে দুর্বলতা হিসেবে দেখতে শুরু করল এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগল। তাদের মনে লোভ আর ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বাসা বাঁধে।

সেই রাজ্যে বাস করত এক সওদাগর, নাম রুস্তম। তার ব্যবসার কোনো সীমা ছিল না। সোনা, রুপা, হীরা, জহরত থেকে শুরু করে খাদ্যশস্য, বস্ত্র, মশলাএমন কোনো জিনিস নেই যা সে ব্যবসা করত না। রুস্তমের নীতি ছিল একটাইযেভাবে হোক, টাকা কামানো চাই। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো নৈতিকতার ধার ধারত না সে। মিথ্যা বলা, ভেজাল দেওয়া, এমনকি চোরাকারবারির সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল।

এভাবে অল্প দিনেই রুস্তম বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে গেল। দেশ-বিদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল একজন ধূর্ত ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। কিন্তু এত সম্পদ থাকার পরেও রুস্তমের মন ছিল অতৃপ্ত। তার মনে রাজা হওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল। সে ভাবত, যদি কোনোভাবে রাজ্যের সিংহাসন দখল করতে পারত, তাহলে তার সম্পদ আরও বেড়ে যেত এবং প্রজাদের উপর আরও বেশি ক্ষমতা ফলাতে পারত।

রুস্তম বুঝতে পারল, প্রজাদের মধ্যে রানীর প্রতি অসন্তোষ বাড়ছে। সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। যখন সে দেখল যে কিছু মানুষ রানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তখন সে আর দেরি করল না। রুস্তম গোপনে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মেলাল এবং রানীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করল।

ধীরে ধীরে রুস্তমের ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করতে লাগল। সে বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করল। একইসঙ্গে, সে প্রজাদের কাছে রানীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাতে লাগল। রুস্তম প্রচার করতে লাগল যে রানী প্রজাদের শোষণ করছেন এবং রাজ্যের সম্পদ নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য ব্যবহার করছেন।

অবশেষে, সেই দিনটি এল যখন বিদ্রোহীরা রানীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। রুস্তমের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহী রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করল। রানীর সৈন্যরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু বিদ্রোহীদের সংখ্যা এবং অস্ত্রের তুলনায় তারা দুর্বল ছিল।

রানী বুঝতে পারলেন যে তাঁর প্রজারা তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে। তিনি সিংহাসন রক্ষার জন্য রক্তপাত চান না। তাই তিনি স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। রানী রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন, আর রুস্তম বিদ্রোহীদের সমর্থন নিয়ে নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসল।

রাজা হয়েই রুস্তম তার আসল রূপ প্রকাশ করল। সিংহাসনে বসার পর সে প্রজাদের উপর আরও বেশি অত্যাচার শুরু করল। প্রথমে, সে প্রজাদের মন জয় করার জন্য কিছু লোক দেখানো কাজ করল। যেমন, সে তার উপর ধার্য করা সকল খাজনা মাফ করে দিল। নতুন নতুন ব্যবসা শুরু করল, যেখানে তার নিজের লাভের অংশ ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু খুব শীঘ্রই প্রজারা বুঝতে পারল যে রুস্তম একজন নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী শাসক। সে প্রজাদের কাছ থেকে আরও বেশি কর আদায় করতে শুরু করল। যারা তার বিরোধিতা করত, তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতো। রুস্তমের উজির নাজির সকলেই রাতারাতি ধনী হয়ে গেল। তারা প্রজাদের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের প্রাসাদ বানাতে লাগলো।

রাজ্যে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হল। রুস্তমের অনুচরেরা এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল যে সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেত না। কেউ যদি সামান্য প্রতিবাদ করত, রুস্তমের লোকেরা তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিত, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করত, অথবা তাকে কারারুদ্ধ করত।

এভাবে কয়েক বছর ধরে রুস্তমের অত্যাচার চলতে থাকল। প্রজারা নীরবে সবকিছু সহ্য করতে লাগল, কিন্তু তাদের মনে ঘৃণা ও ক্ষোভ জমতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।

একদিন, কিছু সাহসী মানুষ রুস্তমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা গোপনে সংগঠিত হতে লাগল এবং রুস্তমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। এই বিদ্রোহে যোগ দিল কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, এমনকি কিছু সৈনিকও।

অবশেষে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল। প্রজারা একজোট হয়ে রুস্তমের প্রাসাদ আক্রমণ করল। রুস্তমের সৈন্যরা বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল, কিন্তু এবার প্রজাদের সংকল্প ছিল দৃঢ়। তারা জীবন বাজি রেখে রুস্তমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে লাগল।

প্রজাদের সম্মিলিত শক্তির কাছে রুস্তমের সৈন্যরা পরাজিত হল। রুস্তম পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রজারা তাকে ধরে ফেলল। তারা রুস্তম এবং তার অনুচরদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রুস্তম ও তার অনুচরদের হত্যা করে তাদের দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল।

রাজ্য আবার স্বাধীন হল, কিন্তু প্রজাদের মনে শান্তি ছিল না। তারা বুঝতে পারছিল যে তাদের ভুলের কারণেই রুস্তমের মতো একজন অত্যাচারী শাসক তাদের উপর চেপে বসেছিল। তারা অনুতপ্ত হল এবং তাদের আগের রানীকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল।

প্রজারা রানীর খোঁজে বের হল। তারা রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে রানীর সন্ধান করল। অবশেষে, তারা জানতে পারল যে রানী পাশের রাজ্যের এক গ্রামে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছেন। প্রজারা সেখানে গিয়ে রানীর কাছে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইল এবং তাঁকে আবার রাজ্যে ফিরে আসার অনুরোধ করল।

কিন্তু রানী ছিলেন অভিমানী। তিনি প্রজাদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন, কারণ তারা তাঁর সরলতাকে দুর্বলতা ভেবেছিল এবং একজন লোভী সওদাগরের কথায় বিশ্বাস করে তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। রানী প্রজাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন এবং রাজ্যে ফিরে যেতে রাজি হলেন না।

রানী বললেন, "আমি তোমাদের ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু তোমাদের রাজা হতে পারব না। তোমরা আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছ। এখন তোমরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করো।"

প্রজারা রানীর সিদ্ধান্ত মেনে নিল। তারা বুঝতে পারল যে তাদের কর্মের ফল তাদের ভোগ করতে হবে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একজন সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নতুন রাজা হিসেবে নির্বাচন করল।

নতুন রাজা প্রজাদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে লাগলেন। তিনি রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন এবং প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সচেষ্ট হলেন। প্রজারাও বুঝতে পারল যে স্বাধীনতা অমূল্য এবং নিজেদের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই।

এই ঘটনার পর থেকে, রাজ্যের প্রজারা আর কখনো কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়নি। তারা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল এবং সর্বদা নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে একজন দয়ালু ও প্রজ্ঞাবান শাসকই একটি রাজ্যের আসল সম্পদ, এবং তার প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য।

আর সেই অভিমানী রানী? তিনি হয়তো দূর থেকে তাঁর প্রাক্তন রাজ্যের প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন, কিন্তু আর কখনো সিংহাসনে ফিরে আসেননি। তাঁর ত্যাগ ও অভিমান প্রজাদের হৃদয়ে চিরকাল গেঁথে রইল এক গভীর শিক্ষা হয়ে।

 


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post