যে গাছ কথা বলে
পার্কের
এক কোণে বহু পুরনো
একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে থাকত। তার ডালপালা বিশাল,
যেন বহু বছর ধরে
সে আকাশের সাথে আলিঙ্গন করে
আছে। গাছের গুঁড়িটা মোটা আর খসখসে,
দেখলে মনে হয় যেন
কত শত বর্ষার জল
আর রোদ্দুরের ইতিহাস তার শরীরে লেখা।
এই গাছের নীচের দিকের একটা ভাঙা বেঞ্চে
রোজ বিকেলে এসে বসতেন বৃদ্ধ
আব্দুল খালেক।
খালেক
সাহেবের বয়স হয়েছে, শরীরে
ভাঁজ পড়েছে, চোখের দৃষ্টিও আগের মতো স্পষ্ট
নয়। কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি এখনও
বেশ সজাগ। তিনি প্রায় প্রতিদিনই
লাঠি ঠুকঠুক করে পার্কে আসতেন
এবং সেই বটগাছটার কাছে
গিয়ে বসতেন। গাছের দিকে তাকিয়ে আপন
মনে কথা বলতেন। কেউ
দেখলে হয়তো ভাবত, বুড়ো
মানুষটা একা একা বকবক
করছে। কিন্তু খালেক সাহেবের কাছে গাছটা শুধু
একটা গাছ ছিল না,
ছিল তার বহুদিনের সঙ্গী,
নীরব শ্রোতা।
তিনি
গাছের কাছে তার দিনের
কথা বলতেন, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতেন। তার ছেলেমেয়েদের খবর,
নাতি-নাতনিদের দুষ্টুমি, এমনকি রাতের স্বপ্নে দেখা কোনো অদ্ভুত
ঘটনার কথাও তিনি গাছের
সাথে ভাগ করে নিতেন।
গাছটা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকত, তার পাতারা বাতাসে
মৃদু শব্দ করত, যেন
বৃদ্ধের কথায় সায় দিচ্ছে।
একদিন
বিকেলে, খালেক সাহেব যথারীতি গাছের নীচে এসে বসলেন।
আকাশ মেঘলা, একটু পরেই হয়তো
বৃষ্টি নামবে। তিনি আনমনে গাছের
গুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলছিলেন,
“আজ শরীরটা তেমন ভালো নেই
রে বাবা। কেমন যেন দুর্বল
লাগছে।”
হঠাৎ,
খালেক সাহেব চমকে উঠলেন। তিনি
স্পষ্ট শুনতে পেলেন, কেউ যেন মৃদু
স্বরে বলল, “মন খারাপ করবেন
না, চাচা। একটু বিশ্রাম নিন,
সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বৃদ্ধ
প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন, পার্কে তেমন কেউ নেই।
কয়েকটি বাচ্চা খেলছে আর দূরে দু’একজন হাঁটছে। তিনি
ভাবলেন, হয়তো ভুল শুনেছেন।
পরের
দিন আবার তিনি সেই
গাছের নীচে গেলেন। গিয়ে
বসতেই আবার সেই মৃদু
স্বর ভেসে এল, “কেমন
আছেন, চাচা?”
এবার
আর ভুল বোঝার উপায়
রইল না। খালেক সাহেব
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গাছের দিকে
তাকিয়ে রইলেন। তার মুখ দিয়ে
কোনো কথা বের হলো
না।
গাছটা
আবার বলল, “ভয় পাবেন না।
আমি আপনার কথা শুনি। রোজ
আসেন, কত গল্প বলেন।
আমারও মাঝে মাঝে কথা
বলতে ইচ্ছে করে।”
খালেক
সাহেব তখনও ঘোর কাটাতে
পারেননি। তিনি ঢোক গিলে
বললেন, “তুমি… তুমি কথা বলতে
পারো?”
“হ্যাঁ,
চাচা। তবে সবাই আমার
কথা শুনতে পায় না। হয়তো
যারা মন দিয়ে শোনে,
তারাই শুধু বুঝতে পারে।”
গাছের পাতাগুলো যেন হালকা কেঁপে
উঠল।
এরপর
থেকে খালেক সাহেবের বিকেলগুলো আরও অন্যরকম হয়ে
উঠল। তিনি রোজ গাছের
সাথে কথা বলতেন, গাছও
তার সাথে নানা বিষয়ে
আলোচনা করত। গাছ তাকে
পুরনো দিনের গল্প শোনাত, প্রকৃতির
রহস্যের কথা বলত। খালেক
সাহেব যেন তার দীর্ঘ
জীবনে এক নতুন বন্ধু
খুঁজে পেলেন।
পার্কের
অন্য লোকেরা হয়তো এখনও ভাবত,
বৃদ্ধ লোকটি একা একা কথা
বলে। কিন্তু খালেক সাহেব জানতেন, তিনি একা নন।
তার পাশে রয়েছে এক
নীরব বন্ধু, যে শুধু শোনেই
না, প্রয়োজন হলে উত্তরও দেয়
– সেই পুরনো বটগাছটা। তাদের সবুজ সংলাপ চলতেই
থাকত, প্রকৃতির নীরব ভাষায় বাঁধা
এক অসাধারণ বন্ধুত্ব।