বিনার জীবন নদী

 বিনার জীবন নদী

বিনার জীবন নদী

বরিশালের ধুলোমাখা পথ আর শিউলি ফুলের গন্ধ। সেই পথে বেড়ে ওঠা এক কিশোরী বিনার জীবনটা শুরু থেকেই যেন ছিল এক অসমাপ্ত কবিতা। রোদপোড়া গায়ের রঙে লাবণ্য, আর চোখে স্বপ্ন। প্রকৃতির দান রূপে সে ছিল অপরূপা, কিন্তু জীবন তাকে দিয়েছিল কেবলই দারিদ্র্যের উত্তরাধিকার। বাবা-মার দিনমজুরির সংকীর্ণ গণ্ডিতেই বিনার জীবন সীমাবদ্ধ ছিল। ৪র্থ শ্রেণী পাস করার পরই স্কুলবইয়ের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, আর বই কেনার পয়সা বা পড়ার সময়, কোনোটাই বিনার পরিবারের কাছে ছিল না।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবার একসময় ভিটেমাটি ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। কেরানীগঞ্জের ঘিঞ্জি, স্যাঁতস্যাঁতে এক বস্তিতে তাদের নতুন ঠিকানা হয়। বরিশালের খোলামেলা পরিবেশ ছেড়ে এসে ইট-পাথরের জঙ্গলে বিনার মন হাঁসফাঁস করত। বয়স বাড়ছিল, তার রূপও বিকশিত হচ্ছিল। এই বস্তির রুক্ষ পরিবেশে তার সৌন্দর্য ছিল এক ব্যতিক্রমী ফুল।

কিছুকাল পর, এক অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আসে। স্থানীয় বাজারে ভ্যানে করে ঝালমুড়ি, চানাচুর আর হাতে তৈরি নানা পদ বিক্রি করা এক লোকের সাথে তার বিয়ের সম্বন্ধ। লোকটির বয়স বিনার দ্বিগুণেরও বেশি, প্রায় বাবার বয়সী। নাম ছিল তার কাশেম মিয়া। তার ছিল শুধু এক কামরার টিনের চালার একটা ছোট্ট ঘরসেটাই তার একমাত্র সম্পত্তি। বিনার বাবা-মা ভেবে দেখলেন, এই বয়সে মেয়েকে অনাহারে রাখার চেয়ে এই বিয়ে শ্রেয়। অন্তত একটা স্থায়ী ছাদ তো জুটবে। বিনা নিঃশব্দে নিয়তি মেনে নিল।

বিয়ের পর বিনার নতুন জীবন শুরু হলো সেই এক কামরার ঘরে। ঘর ছোট হলেও, কাশেম মিয়ার মনটা ছিল বড়। সারাদিন বাজারে খেটে যা রোজগার করতেন, তা দিয়ে বিনাকে সুখেই রাখার চেষ্টা করতেন। অভাব ছিল, কিন্তু শান্তিও ছিল। কাশেম মিয়া বিনাকে ভালোবাসতেন, যত্ন নিতেন। ঝালমুড়ির ভ্যানের ব্যবসা ভালোই চলছিল। সকালে কাশেম মিয়া ভ্যান নিয়ে বের হতেন, আর বিনা ঘরে বাজার গোছানো, রান্না করা আর ছোট্ট ঘরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে ব্যস্ত থাকত। সন্ধ্যায় কাশেম ফিরলে দুজনে একসাথে খেতেন, বাজারের গল্প করতেন। বিনার মনে হতো, এই বুঝি জীবনের মানে।

কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সংসারে নতুন আলো হয়ে এলো এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। তুলতুলে নরম শরীর আর মায়ের মতো টানা টানা চোখ। মেয়ের নাম রাখা হলোআলেয়া’, মানেআলোর পথ আলেয়ার আগমনে সেই এক কামরার ছোট্ট ঘরটা যেন স্বর্গ হয়ে উঠল। বিনার সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত মেয়ের মুখ দেখে। কাশেম মিয়াও মেয়েকে কোলে নিয়ে আহ্লাদ করে সময় কাটাতেন। দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু এই ভালোবাসায় মোড়ানো সংসারে সুখের কোনো কমতি ছিল না। আলেয়ার হাসিতে তাদের ছোট্ট কুটির ভরে থাকত।

কিন্তু বিধাতা বুঝি বেশিদিন এই সুখ সইতে পারলেন না। হঠাৎ একদিন কাশেম মিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রথমটা ভাবলেন, সাধারণ জ্বর বা সর্দি। কিন্তু রোগটা সহজে ছাড়ল না। শরীরটা দিন দিন দুর্বল হয়ে যেতে লাগল। বাজারে ভ্যান নিয়ে দাঁড়াতেই কষ্ট হতো, ঝালমুড়ি মাখার শক্তি পেতেন না। ডাক্তার দেখালে ধরা পড়ল এক জটিল রোগ, যা তার কর্মক্ষমতা পুরোপুরি কেড়ে নিল।

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বিছানায় পড়ে যাওয়ায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল বিনার। সঞ্চয় বলতে কিছু ছিল না। একদিকে অসুস্থ স্বামী, অন্যদিকে দুধের শিশু আলেয়া। দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। কী করবেন? কে দেখবে সংসার? প্রতিবেশীরা এসে সান্ত্বনা দিত, কেউ কেউ সামান্য সাহায্যও করত, কিন্তু এভাবে তো সংসার চলতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজখবর করে বিনা একটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়ার চাকরি পেলেন। সামান্য মাইনে, কিন্তু তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। ভোরবেলা উঠে ঘর গৃহস্থালীর কাজ সেরে, অসুস্থ স্বামীকে প্রতিবেশীর জিম্মায় রেখে, বুকে পাথর বেঁধে আলেয়াকে কোলে নিয়ে স্কুলে যেতেন। স্কুল ছুটির পর আবার আলেয়াকে নিয়ে ঘরে ফিরে কাশেম মিয়ার সেবা শুশ্রুষা করতেন, রান্না করতেন। এই নতুন রুটিন ছিল বড় কঠিন। শরীর আর মন দুটোই ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু আলেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতেন বিনা। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতেন। সংসারটা আবার টেনেটুনে চলতে শুরু করল। অভাব পিছু ছাড়েনি, কিন্তু দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটত।

এভাবেই কাটছিল দিন। আলেয়া একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। কথা বলতে শিখেছিল, হাঁটতে শিখেছিল। বাবার অসুস্থতা সে ঠিক বুঝত না, শুধু দেখত বাবা বিছানায় শুয়ে থাকে। বিনার বুকটা ফেটে যেত।

একদিন, আকস্মিকভাবে সব শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘ রোগভোগের পর কাশেম মিয়া বিনা আর আলেয়াকে শোকে সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেলেন। বিনা যেন নির্বাক হয়ে গেল। জীবনের এই দ্বিতীয় আঘাত তাকে স্থবির করে দিল। যে মানুষটা জীবন চলার পথের সঙ্গী ছিল, যার সামান্য ছাদটুকু ছিল তার আশ্রয়, সে- চলে গেল। এখন সে একা, তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে। প্রতিবেশীদের সাহায্য আর স্কুলের শিক্ষকদের সহানুভূতিতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো।

স্বামীর মৃত্যুর পর বিনার কাঁধে সংসারের পুরো ভার এসে পড়ল। সেই ছোট্ট আয়ার চাকরিটুকুই ছিল একমাত্র অবলম্বন। স্কুল থেকে ফিরে আলেয়াকে নিয়ে ঘরে ফিরতেন। ঘরের প্রতিটি কোণায় যেন কাশেম মিয়ার স্মৃতি লেগে ছিল। ছোট্ট আলেয়াও বাবাকে খুঁজত। মায়ের ভেজা চোখ দেখে নিজেও কাঁদত। বিনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতেন, কিন্তু নিজের ভেতরের কান্নাটা লুকোতে পারতেন না।

দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম আর মানসিক চাপে বিনার শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। প্রায়ই মাথাব্যথা করত, শরীর দুর্বল লাগত। প্রথমদিকে ভেবেছিলেন, হয়তো বেশি কাজের চাপ আর দুশ্চিন্তার কারণে এমনটা হচ্ছে। কিন্তু মাথাব্যথাটা ক্রমেই অসহ‌্য হয়ে উঠল। চোখে ঝাপসা দেখতেন মাঝে মাঝে, বমি ভাব হত। স্কুলের শিক্ষকরা তার এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হলেন। প্রধান শিক্ষিকা তাকে ডাক্তার দেখাতে বললেন।

কোনোরকমে টাকা ধার করে ডাক্তার দেখালেন বিনা। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা করানো হলো। রিপোর্ট হাতে আসার পর বিনা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না। ডাক্তার যা বললেন, তা শুনে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। ব্রেইন টিউমার!

বিনাকে বলা হলো, তার মাথায় একটি টিউমার ধরা পড়েছে। সেটার অপারেশন প্রয়োজন, এবং তার জন্য অনেক টাকা লাগবে। বিনা যেন পাথর হয়ে গেল। ব্রেইন টিউমার? তার? তার কী হবে? তার আলেয়ার কী হবে? কে দেখবে তার মেয়েকে? এই সামান্য আয়ার চাকরি দিয়ে তার নিজের দুবেলা খাবার জোটানোই কঠিন, সেখানে এত টাকার অপারেশন!

আবারও সেই অন্ধকারের খাদে এসে পড়ল বিনা। একদিকে জীবন বাঁচানোর তাগিদ, অন্যদিকে অসম্ভব ব্যয়ভার। তার ছোট্ট মেয়ের ভবিষ্যৎ। হাসপাতালের বেডে শুয়ে বিনার কেবলই আলেয়ার মুখটা মনে পড়ত। মা ছাড়া আর কাকে চেনে? যদি তার কিছু হয়ে যায়? কে তার খেয়াল রাখবে? দারিদ্র্য যেন পদে পদে তার জীবনকে ঘিরে ধরেছিল। বেঁচে থাকার অধিকারও যেন কেড়ে নিতে চেয়েছিল।

কিন্তু বিনা হাল ছাড়লেন না। ছোটবেলা থেকেই প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে সে। দারিদ্র্য তাকে দুর্বল করেনি, বরং স্থিরতা শিখিয়েছে। তার মনে পড়ল কাশেম মিয়ার কথা। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি শেষদিন পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। আর তার আলেয়া, যার মুখে সে তার সব স্বপ্ন দেখত। সে বাঁচতে চাইত আলেয়ার জন্য।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং অন্য শিক্ষকরা বিনার পাশে দাঁড়ালেন। তারা স্কুলের অন্যান্য স্টাফ, অভিভাবক এবং স্থানীয় বাজারে প্রচার করে বিনার চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইতে শুরু করলেন। তার প্রতিবেশীরাও যার যা সাধ্য ছিল, সাহায্য করল। কাশেম মিয়ার পুরানো সহকর্মীরা, যারা ভ্যানে ঝালমুড়ি বিক্রি করত, তারাও চাঁদা তুলল। ছোট ছোট অঙ্কের টাকা জমতে শুরু করল। সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে চিকিৎসার খরচ কিছুটা কমে আসার সম্ভাবনা দেখা গেল।

বিনা ভর্তি হলেন হাসপাতালে। তার শরীর খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। আলেয়াকে রেখে যেতে বুক ফেটে যাচ্ছিল। প্রধান শিক্ষিকা ভরসা দিলেন, আলেয়াকে তারা দেখবেন।

চিকিৎসা শুরু হলো। অপারেশনটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিনা সর্বক্ষণ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তার মনে ছিল শুধুমাত্র আলেয়ার মুখ। বাঁচার তীব্র আকুতি তাকে সাহস জোগাচ্ছিল। দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রনা সহ্য করেছেন। অপারেশন হলো, তারপর দীর্ঘ সময় লেগেছে জ্ঞান ফিরতে, শরীর স্বাভাবিক হতে।

কয়েক মাস কেটে গেল। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে বিনা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগলেন। শরীর অত্যন্ত দুর্বল, কিন্তু মনের জোর ছিল প্রবল। ডাক্তারেরা তার উন্নতি দেখে আশাবাদী হচ্ছিলেন। নার্সরা তার যত্ন নিতেন। দূর থেকে আলেয়ার খোঁজখবর পেতেন। জানতে পারতেন, মেয়ে ভালো আছে, স্কুলের শিক্ষকরা তার দেখাশোনা করছেন। এই খবরটাই ছিল তার বাঁচার অক্সিজেন।

অবশেষে একদিন বিনা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন। সম্পূর্ণ সুস্থ নন, শরীর এখনো দুর্বল, মাথায় অপারেশনের দাগ। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন। আলেয়ার কাছে ফিরে যাচ্ছেন। যে জীবনটা তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল বলে মনে হয়েছিল, সেই জীবনটাকেই সে আঁকড়ে ধরে ফিরছেন।

যখন তিনি ছোট্ট এক কামরার ঘরে ফিরে এসে আলেয়াকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, তখন মনে হলো এই মুহূর্তটার জন্যই বুঝি এত লড়াই। আলেয়া প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও তার শীর্ণ মায়ের মুখ চিনতে পেরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মা আর মেয়ের দীর্ঘ বিচ্ছেদের কান্না সেদিনের বাতাস ভারী করে তুলেছিল।

বিনা ফিরে এসেছেন। তার জীবননদী অনেক চড়াই-উতরাই পার করে নতুন বাঁক নিয়েছে। দারিদ্র্য আজও তার সঙ্গী, জীবনযুদ্ধ আজও চলছে। কিন্তু তিনি জিতেছেন। অসুস্থতাকে হার মানিয়ে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে তিনি প্রমাণ করেছেন, মানুষের ইচ্ছাশক্তি আর বেঁচে থাকার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যেকোনো প্রতিকূলতা জয় করতে পারে। সেই ছোট্ট আয়ার চাকরিটা হয়তো এখনো আছে, আলেয়ার ভবিষ্যৎ তৈরির দায়িত্ব এখনো তারই। কিন্তু বিনার চোখে এখন কেবল অনিশ্চয়তা নয়, বরং এক নতুন দৃঢ়তা, এক অমিত শক্তি আর বেঁচে থাকার এক গভীর বোধ। প্রতিটি নতুন সকাল তার কাছে এক নতুন উপহার, আলেয়ার মুখের হাসি তার বেঁচে থাকার কারণ। বিনার জীবনযুদ্ধ হয়তো শেষ হয়নি, কিন্তু সে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি প্রাণবন্ত।

 

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم

Ad

Ad