সুন্দরবনের গহীনে এক হারানো রহস্য

সুন্দরবনের গহীনে এক হারানো রহস্য

সুন্দরবনের গহীনে এক হারানো রহস্য

ডিসেম্বর মাস, ২০২৪। কনকনে শীতের ছোঁয়াচ লেগেছে শহরে, যদিও দক্ষিণবঙ্গে শীতের তীব্রতা ততটা নয়। স্কুল ছুটি শুরু হয়ে গেছে। হক সাহেব, যিনি সারাবছর কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন, ভাবলেন এই সুযোগে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসলে মনটা তাজা হবে। একটানা স্কুল আর সংসারের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দরকার। প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হলো। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, এবার সুন্দরবন যাওয়া যাক। ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূলীয় জঙ্গল, বাঘের ডাক, আর নদীর স্রোত – সবকিছু মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হতে পারে

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পরিচিত একটি ট্যুর গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করলেন। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ রাতে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে তাদের লঞ্চ ছাড়বে। দ্রুত টিকিট বুক করে নিলেন। যাত্রার দিন বাক্সপেটরা গুছিয়ে সময়মতো পৌঁছে গেলেন লঞ্চঘাটে। বিশাল লঞ্চে আগে থেকেই অনেকে এসে বসেছেন। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার মানুষ। সকলের চোখেমুখে সুন্দরবন দেখার উত্তেজনা

রাত তখন প্রায় ১০টা। লঞ্চ ছাড়ল। শীতের রাতের শিরশিরে বাতাস আর নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মনকে শান্ত করে দিল। খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে চাঁদনী রাতের নদীর শোভা দেখছিলেন হক সাহেব। অচেনা সহযাত্রীদের সাথে টুকটাক গল্পও হলো। রাতের খাবার সেরে নির্ধারিত কেবিনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি

ভোর ৫টা নাগাদ যখন ঘুম ভাঙল, হক সাহেব টের পেলেন লঞ্চ এসে নোঙর করেছে। বাইরে আবছা আলো-আঁধারি। ঠান্ডা বাতাস বইছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি চলে এসেছেন তারা। লঞ্চের ডেকের সবাই ইতোমধ্যে জড়ো হতে শুরু করেছেন। কুয়াশার হালকা চাদর সরে যেতেই ম্যানগ্রোভের ঘন সবুজ বনরেখা চোখে পড়ল। সে কী উন্মাদনা সবার মাঝে! পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। জঙ্গলের ভেতরের চাপা রহস্যময়তা ভোরের আলোয় আরও গভীর মনে হচ্ছে

সকালের নাস্তা সেরে সবাই সুন্দরবনের গহীনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হলেন। ছোট ছোট বোটে করে বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখানো হবে। গাইড সুন্দরবনের নিয়মকানুন, বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষার উপায় ইত্যাদি বুঝিয়ে দিলেন। হক সাহেব তার নির্দিষ্ট গাইড ও বোটের সহযাত্রীদের সাথে যাত্রা শুরু করলেন

বোট ম্যানগ্রোভের সরু খালের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। দুপাশে সুন্দরী, গেওয়া, গরান গাছের সারি। শ্বাসমূলগুলো উঠে আছে মাটির উপরে। মাঝে মাঝে বানরের দল আর চিত্রা হরিণের পাল চোখে পড়ছে। বনের ভেতরের নিস্তব্ধতা মুগ্ধ করার মতো। কেবল বোটের ইঞ্জিনের শব্দ আর পাখির ডাক এই নিস্তব্ধতা ভাঙছে। গাইড বিভিন্ন গাছের নাম, সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সম্পর্কে বলছিলেন। হক সাহেব মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন আর ছবি তুলছিলেন

একটা জায়গায় এসে গাইড বললেন, এখানে কিছুক্ষণ বোট থামবে। আপনারা চাইলে নেমে একটু হেঁটে দেখতে পারেন। তবে গাইডকে অনুসরণ করবেন এবং দলবদ্ধ থাকবেন। জায়গাটা তেমন ঘন নয়, কিছুটা খোলা। গাছপালা কম। অনেকেই উৎসাহ নিয়ে বো থেকে নামলেন। হক সাহেবও নামলেন। বনের ভেতরের মাটি নরম, কাদাকাদা। সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে

মাঝেমধ্যে দুএকজন সহযাত্রীর সাথে কথা বলছিলেন হক সাহেব। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, একটু দূরে একটি গাছের নিচে অদ্ভুত আকারের একটি পাথর পড়ে আছে। তার কৌতূহল হলো। কাছে গিয়ে দেখতে গেলেন। পাথরটি দেখতে ঠিক স্বাভাবিক পাথরের মতো নয়, যেন কিছুটা খোদাই করা। তিনি ঝুঁকে পাথরটি পর্যবেক্ষণ করছেন, ছবি তোলার জন্য মোবাইল বের করেছেন

ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ তার কানে এলো গাইড তার দলের অন্যদের বোটে ওঠার জন্য ডাকছেন। তিনি দ্রুত ঘুরে দেখেন, তার বোটটি একটু দূরে চলে গেছে এবং বাকিরাও উঠে পড়েছে। তিনি হাত নাড়লেন, কিন্তু তারা তাকে দেখতে পেল না। হয়তো গাছের আড়ালে চলে গিয়েছিলেন তিনি

এক মুহূর্তের জন্য হক সাহেবের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এ কী করলেন তিনি! দলছুট হয়ে পড়েছেন! ঘাবড়ে গেলেন তিনি। চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলেন, "এই যে শুনছেন! আমি এখানে!"

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর গহন জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় মিলিয়ে গেল। বোটের ইঞ্জিন সাউন্ড ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে একসময় আর কানে এলো না। তিনি একা দাঁড়িয়ে রইলেন। চারপাশের ম্যানগ্রোভ গাছগুলো যেন বিশাল দৈত্যের মতো তাকে ঘিরে ধরেছে। সূর্য তখন বেশ উপরে উঠে গেছে, তবে জঙ্গলের ভেতরে সূর্যের আলো তেমন প্রবেশ করছে না। একটা চাপা ভয়ের স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল

ঘাবড়ে গেলেও হক সাহেব নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে খাল দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বোটগুলো এই খাল দিয়েই যাবে। তিনি খালের পাড় ধরে হাঁটা শুরু করলেন। যদি কোনো বোট আসে, তবে দেখা যাবে

কিন্তু পথ যেন ফুরায় না। খালের পাড় কোথাও উঁচু, কোথাও আবার কাদাময়। পা ডুবে যাচ্ছে। হাঁটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। আর কোনো বোট আসছে না। চারপাশের জঙ্গল ক্রমশ ভয়ংকর নিস্তব্ধ হয়ে উঠছে। কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও হরিণের ডাক বা অন্য কোনো প্রাণীর শব্দ শোনা যাচ্ছে যা তার ভয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের গহীনের বিপদ সম্পর্কে তার জানা আছে – বাঘ, কুমির, সাপ!

ঘণ্টাখানেক হেঁটেও কোনো জনমানবের দেখা পেলেন না। শরীর ক্লান্ত হয়ে আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। সময় জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছেন তিনি। কতক্ষণ ধরে হাঁটছেন কে জানে!

হঠাৎ তিনি দূর থেকে একটা ক্ষীণ স্বর শুনতে পেলেন। তার নিজের নাম ধরে কেউ ডাকছে! "হক সাহেব! আপনি এখানে?"

হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। এ তো অসম্ভব! এখানে এই গহীন জঙ্গলে কে তাকে চিনবে? তিনি পাল্টা ডাকলেন, "কে? কে ডাকছেন?"

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোপের আড়াল থেকে একজন তরুণী বেরিয়ে এলো। পরনে জিন্স আর টি-শার্ট, কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ। চেহারা মায়াবী কিন্তু চোখেমুখে কাঠিন্য। হক সাহেব তাকে চিনতে পারলেন। সে তাদের ট্যুর গ্রুপের একজন সহযাত্রী, নাম মিতু। শান্ত স্বভাবের, বিশেষ কারও সাথে কথা বলতে দেখা যায়নি

হক সাহেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। "আরে মিতু! তুমি এখানে? আমি তো ভেবেছিলাম আমি একা হারিয়ে গেছি।"

মিতুর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। শান্ত গলায় বলল, "আমি আপনার কিছুটা পেছনেই ছিলাম। আপনি যখন ওই পাথরটা দেখছিলেন, আমি আপনাকে খেয়াল করছিলাম। আপনি যখন দলছুট হয়ে গেলেন, আমি আপনাকে দেখতে পেলাম। কিন্তু গাইডকে আর বোঝাতে পারিনি। তাই আপনার পিছু নিয়েছি।"

হক সাহেব অবাক হলেন। "আমার পিছু নিয়েছ মানে? তুমিও তো তাহলে হারিয়ে গেলে?"

মিতু মাথা নাড়ল। "হারিয়ে যাইনি। এই জায়গাটা আমি চিনি।"

হক সাহেবের বিস্ময় আরও বাড়ল। "চেনো মানে? তুমি কি আগেও এসেছ এখানে?"

মিতু সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, "চলুন, দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। বিকেল হয়ে আসছে। জোয়ার শুরু হওয়ার আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। নয়তো পুরো এলাকা ডুবে যাবে।"

মিতুর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে হক সাহেব প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলেন। মিতু দ্রুত হাঁটছিল। সে খালের পাড় ধরে না গিয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে প্রবেশ করল। হক সাহেব দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পিছু নিলেন

মিতু কিন্তু সাধারণ পথ দিয়ে হাঁটছিল না। সে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন দেখে দেখে পথ চলছিল। কখনো গাছের গায়ে আঁচড়, কখনো ভাঙা ডাল। হক সাহেব বুঝতে পারলেন, মিতু যেন এই জঙ্গলের ভেতরের গোপন পথ জানে

"মিতু," হক সাহেব সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি সত্যি করে বলো তো, তুমি কে? এই জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে আছো কেন?"

মিতু থামল। তার চোখেমুখে রহস্যময়তা। "আমি লুকিয়ে নেই হক সাহেব। আমি একটা বিশেষ কাজে এসেছিলাম। প্রায় শেষ হয়ে আসছিল, তার মধ্যেই আপনাকে দেখে পিছু নিতে হলো।"

"বিশেষ কাজ? সুন্দরবনের ভেতরে?"

"হ্যাঁ। এমন কিছু খুঁজছি যা এখানকার প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে... বা নষ্টও করে দিতে পারে।" মিতুর কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলেন না হক সাহেব। তার মনে হলো মিতু যেন অনেক কিছু গোপন করছে

তারা হাঁটতে হাঁটতে আরও গহীন অঞ্চলে প্রবেশ করলেন। গাছপালা আরও ঘন, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। হঠাৎ মিতু থেমে গেল। "সাবধান! সামনে বিপদ আছে।"

হক সাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কী বিপদ?"

"মানুষের বিপদ," মিতু ফিসফিস করে বলল। "চোরা শিকারী। আমি ওদেরই অনুসরণ করছিলাম।"

হক সাহেবের গা ছমছম করে উঠল। চোরা শিকারী! সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ এরা। বাঘ, হরিণ, কুমির শিকার করে। এদের হাতে পড়লে কী হবে কে জানে!

মিতু তাকে ইশারা করল নিচু হতে। তারা দুটো বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কয়েকটি লোকজনের ফিসফিস কথা শুনতে পেলেন। মনে হলো তারা কোনো ভারী জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় বাঘের চামড়া আর হাড়গোড়ের উল্লেখ শুনে হক সাহেব আতঙ্কে জমে গেলেন। এরা বাঘ শিকারী!

লোকগুলো চলে গেলে মিতু ইশারা করল। তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়লেন। মিতুর মুখ দেখে মনে হলো সে হতাশ হয়েছে। "ওরা মনে হয় মাল পাচার করে দিয়েছে এতক্ষণে। আমার ওদের হাতেনাতে ধরার পরিকল্পনা ছিল।"

"তুমি ওদের ধরতে চেয়েছিলে? একা একা? তুমি কি পাগল! এরা ভয়ংকর লোক!" হক সাহেব প্রায় চিৎকার করে উঠলেন

"আমার কাছে উপায় ছিল না। এদের থামানো খুব জরুরি ছিল।" মিতুর কণ্ঠে দৃঢ়তা

হক সাহেব ক্রমশ মিতুর রহস্যময়তায় ডুবে যাচ্ছিলেন। এই শান্ত তরুণী কে? কেন সে এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছে?

তারা আবার হাঁটতে শুরু করলেন। মিতু এবার বনের ভেতরের আরও দুর্গম পথ বেছে নিল। মনে হলো সে বিশেষ কোনো গন্তব্যে যাচ্ছে। হক সাহেব পিছ পিছিয়ে হাঁটতে লাগলেন

কিছুক্ষণ পর তারা একটা ছোট খোলা জায়গায় এসে পৌঁছালেন। জায়গাটা জঙ্গলের অন্য অংশ থেকে কিছুটা আলাদা। এখানে কয়েকটি পাথরের স্তূপ পড়ে আছে, দেখে মনে হয় কোনো প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। আর তার মাঝে অদ্ভুত আকারের সেই পাথরগুলো, যেটা দেখে হক সাহেব দলছুট হয়েছিলেন

"এই জায়গাটা কী?" হক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন

"এটা একটা প্রাচীন স্থান," মিতু বলল। "জানি না কত পুরনো। স্থানীয় কিংবদন্তী আছে এখানে একসময় কিছু বিশেষ কাজ হতো। এখানকার মাটি আর পাথরে কিছু বিশেষত্ব আছে।"

মিতু তার ব্যাগ থেকে কয়েকটি যন্ত্র বের করল। একটি মেটাল ডিটেক্টরের মতো কিছু, আর একটি কম্পাসের মতো জিনিস। সে জায়গাটি পরীক্ষা করতে শুরু করল

"তুমি কী খুঁজছো মিতু?" হক সাহেব জানতে চাইলেন

"ওই পাথরটা," মিতু বলল। "যেটা দেখে আপনি থমকে গিয়েছিলেন। ওটা সাধারণ পাথর নয়। এটা একটা সাংকেতিক পাথর। এই জায়গাটার সূত্র ওটার মধ্যে লুকিয়ে আছে।"

মিতু সেই পাথরটি হাতে নিল। সূর্যের আলোয় পাথরটির গায়ে খোদাই করা কিছু চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠল। চিহ্নগুলো অদ্ভুত, আগে কখনো দেখেননি হক সাহেব

"এই চিহ্নগুলো একটা মানচিত্রের অংশ," মিতু ব্যাখ্যা করল। "এটা একটা গোপন পথের নির্দেশ দেয়। আমি অনেক দিন ধরে এই পথ খুঁজছি।"

মিতু যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে একটি নির্দিষ্ট পাথরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যন্ত্রটি জোরে শব্দ করতে শুরু করল। মিতুর চোখেমুখে উত্তেজনা ফুটে উঠল

"পেয়েছি!" সে বলল। "এর নিচেই কিছু আছে।"

তারা দুজনে মিলে পাথরটি সরানোর চেষ্টা করলেন। পাথরটি বেশ ভারী। অনেক কষ্টে সেটি সরাতেই নিচে একটি ছোট গর্ত দেখা গেল। গর্তের ভেতরটা অন্ধকার। মিতু তার ব্যাগ থেকে একটি টর্চ বের করে আলো ফেলল

গর্তের ভেতরে একটি পাথরের বাক্স দেখা গেল। বাক্সটির গায়েও সেই অদ্ভুত চিহ্নগুলো খোদাই করা। মিতু সাবধানে বাক্সটি বের করল

"এটাই আমি খুঁজছিলাম," মিতু বলল। "এই বাক্সটার ভেতরে এমন কিছু আছে যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।"

হক সাহেব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কী আছে এর ভেতরে?"

মিতু ঢাকনা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু ঢাকনাটা শক্তভাবে আটকানো। হঠাৎ তারা পেছনে ঝোপের মধ্যে শব্দ শুনতে পেলেন। মিতু দ্রুত আলো নিভিয়ে দিল

সেই চোরা শিকারীরা ফিরে এসেছে! মনে হচ্ছে তারা কিছু খুঁজতে এসেছে। হয়তো মিতু তাদের অনুসরণ করার সময় কিছু প্রমাণ বা সূত্র ফেলে এসেছিল যা ওরা খুঁজে পেয়েছে এবং এই জায়গাটা সন্দেহ করেছে

শিকারীরা ফিসফিস করে কথা বলছে। তারা ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হক সাহেব আর মিতু পাথরের স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। তাদের হার্টবিট দ্রুত হয়ে গেছে

"ওরা মনে হচ্ছে আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে," হক সাহেব ফিসফিস করলেন

"আমাদের এখন পালাতে হবে," মিতু বলল। "বাক্সটা নিয়ে।"

পরিস্থিতি ভয়ংকর। একদিকে গহীন জঙ্গল আর তার বিপদ, অন্যদিকে সশস্ত্র চোরা শিকারীরা। মিতু ইশারা করল। তারা অতি সন্তর্পণে উল্টো দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করলেন। শিকারীরা তাদের অবস্থান আন্দাজ করে ফেলায় গুলি চালানোর সম্ভাবনা ছিল

ভাগ্যক্রমে, জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল এবং গাছপালার আড়াল থাকায় তারা শিকারীদের চোখ এড়াতে সক্ষম হলেন। পিছু পিছু ধাওয়া করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তারা। মিতু দ্রুত হাতে বাক্সের ভেতরে থাকা একটি ছোট বোতল বের করে নিল এবং বাক্সটি ফেলে দিল

"বাক্সটা ফেলে দিলে কেন?" হক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন

"ওটা শুধু একটা লুকানোর জায়গা ছিল। আসল জিনিস এই বোতলে।"

বোতলের ভেতরে ঘন সবুজ রঙের একটি তরল পদার্থ ছিল। কী এটা? প্রশ্নটা মনে এলেও এখন জিজ্ঞেস করার সময় নয়

তারা প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলেন। জঙ্গলের ভেতরের অন্ধকারে দৌড়ানো কঠিন। গাছের ডালপালায় ধাক্কা খাচ্ছিলেন। কাদা পিছল। পেছনে শিকারীদের ধাওয়া করার শব্দ ক্রমশ কাছে আসছিল। গুলির শব্দও শুনতে পেলেন একবার, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট ছিল

মিতু কিন্তু ঠিক পথেই ছুটছিল। মনে হচ্ছিল সে অনেক দিন ধরে এই পথ চেনে। হয়তো এই পরিস্থিতির জন্যই সে প্রস্তুত ছিল

ছুটতে ছুটতে তারা একটা খালের কাছাকাছি এসে থামলেন। খালটা বেশ চওড়া। রাতের অন্ধকারে তার জল কালো দেখাচ্ছে

"এখন কী হবে?" হক সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন। "খাল পার হবো কী করে?"

"এই খাল দিয়ে আমাদের বোট আসার কথা ছিল," মিতু বলল। "কিন্তু ওরা এসে পড়ায় সবকিছু ভেস্তে গেছে। এখন অন্য পথ।"

হঠাৎ মিতু থেমে গেল। কান খাড়া করে কিছু শুনল। "শুনুন! দূরে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।"

হক সাহেবও মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, ক্ষীণ হলেও একটা ইঞ্জিনের শব্দ আসছে

"ওটা আমাদের দলের বোট হতে পারে!" হক সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন

"না," মিতু বলল। "ওটা শিকারীদের স্পিডবোট। ওরা এদিকেই আসছে।"

তাহলে পালানোর পথ নেই! হক সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়লেন

"আমাদের জলের নিচে নামতে হবে," মিতু বলল। "জলের নিচে একটি প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ আছে। ওটা দিয়ে অন্য একটি খালে বেরোনো যায়।"

জলের নিচে সুড়ঙ্গ! রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের খালের কালো জলে নামা মানে কুমির আর অন্যান্য বিপদের মুখোমুখি হওয়া। হক সাহেবের বুক ভয়ে কেঁপে উঠল

"ভয় পাবেন না," মিতু বলল। "সুড়ঙ্গটা ছোট, কিন্তু নিরাপদ। শ্বাস ধরে রাখতে হবে কিছুক্ষণ।"

পেছনে শিকারীদের ধাওয়া করার শব্দ আরও কাছে চলে এসেছে। আর কোনো উপায় নেই। মিতু আগে জলে নামল। হক সাহেব ইতস্তত করে তার অনুসরণ করলেন। ঠান্ডা জল শরীর বরফের মতো ঠান্ডা করে দিল। তারা ডুব দিলেন

জলের নিচে অন্ধকার এবং স্যাঁতস্যাঁতে। মিতু তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছে কয়েক মিনিট ধরে তারা জলের নিচে ছিলেন। শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে মিতু তাকে উপরে টেনে তুলল

তারা অন্য একটি খালে এসে উঠেছেন। এই খালটি আগেরটির চেয়ে সংকীর্ণ। আশেপাশে গাছপালা আরও ঘন। আর সবচেয়ে বড় কথা, পেছনে ধাওয়ার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। তারা শিকারীদের এড়িয়ে আসতে পেরেছেন

কিন্তু তারা কোথায় আছেন? রাত হয়ে গেছে। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল জোনাকির আলো জ্বলছে

মিতু অবশ্য বিচলিত হলো না। সে ভেজা কাপড়ে বসেই তার বোতলটি বের করল

হক সাহেব কাঁপছিলেন। ভেজা শরীর আর রাতের ঠান্ডা মিলেমিশে জাঁকিয়ে বসেছিল। "এখন কী হবে মিতু? আমরা কোথায় এসেছি?" তার কণ্ঠস্বরে ছিল ক্লান্তি আর দিশেহারা ভাব।

মিতু কোনো কথা বলল না। মনোযোগ দিয়ে তার বোতলটি হাতে নিলো। ঘন সবুজ তরলটি অন্ধকারেও সামান্য আভা ছড়াচ্ছে। সে বোতলের ছিপি সাবধানে খুলল। তরলটা বেশ আঠালো মনে হলো

সে একটি হাতের আঙুলে এক ফোঁটা তরল নিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখল। এই নতুন খালপাড়ের গাছগুলো কেমন যেন অচেনা। কিন্তু মিতুর চোখ কিছু একটা খুঁজছিল। সে একটি বিশেষ ধরনের ফার্ন গাছের কাছে গেল। রাতের অন্ধকারেও সে যেন ওটাকে চিনতে পারল

মিতু সেই ফার্ন গাছের একটি পাতার নিচের দিকে এক ফোঁটা তরল আলতো করে ঘষে দিল। মুহূর্তেই অবাক কাণ্ড! পাতাটি মৃদু সবুজ আলোয় জ্বলে উঠল। জোনাকির আলোর চেয়ে স্থির, কিন্তু উজ্জ্বলতা কম

"এটা কী করলে?" হক সাহেব বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন

"এটা 'অরণ্য আলো'," মিতু ফিসফিস করে বলল। "এই তরল জঙ্গলের নির্দিষ্ট কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে পথ দেখায়।"

সে আরও কয়েকটি একই রকম ফার্ন খুঁজে বের করল এবং সেগুলোতেও এক ফোঁটা করে তরল দিল। অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু সবুজ আলো জ্বলে উঠল, অনেকটা পথের নির্দেশকের মতো

"এই আলো আমাদের পথ দেখাবে," মিতু বলল। "এই পথ সাধারণত কেউ ব্যবহার করে না। শিকারীরাও এদিকে আসবে না।"

হক সাহেব মুগ্ধ হয়ে জ্বলে ওঠা পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিপদের মধ্যে এমন অদ্ভুত জিনিস দেখে ভয় কিছুটা কমল, কিন্তু বিস্ময় আরও বাড়ল। এই মিতু মেয়েটি কে? সে কী করে এই সব জানে?

"আমরা এই আলো অনুসরণ করে যাব," মিতু বলল। "বেশি সময় নেই, এই আলো কিছুক্ষণ পরেই নিভে যাবে।"

সে বোতলটি আবার সাবধানে বন্ধ করে প ্যাকেটের ভেতরে রাখল। তারপর জ্বলে ওঠা প্রথম পাতাটির দিকে ইশারা করে বলল, "চলুন।"

হক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ভেজা কাপড়ের অস্বস্তি আর ঠান্ডার কামড় উপেক্ষা করে তিনি মিতুকে অনুসরণ করলেন। অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু সবুজ আলো যেন তাদের এক অন্য জগতে, জঙ্গলের গভীরে এক অজানা গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে পড়ে রইল ধাওয়া করা শিকারী, আর সামনে কেবল অনিশ্চিত পথ আর রহস্যময় অরণ্য আলো

সকল গল্প পড়তে ভিজিট করুন: The World of Story

  

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم

Ad

Ad