হারানো পথের সন্ধানে দুই ভিনগ্রহী
নীল গ্রহের বুকে তখন সবে
গোধূলির মায়া নামছে। দিগন্তরেখার
ওপারে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, আর
তার শেষ রেশটুকু লেগে
আছে আকাশ আর মেঘের
গায়ে। সেই মায়াবী আলোয়
ঢাকা শান্ত এক গ্রামে, ধানক্ষেতের
পাশে একটা পুরোনো, জীর্ণ
মন্দিরের পেছনে লুকানো ছিল দুই ভিন্ন
গ্রহের প্রাণী—কোজো আর লুম্বা।
কোজো দেখতে অনেকটা ছোটখাটো ভালুকের মতো, কিন্তু তার
সারা শরীর ঢাকা ছিল
নরম, সবুজ লোমে। তার
চোখগুলো বড় বড় আর
সোনালী রঙের, আর তার মুখটা
সবসময় হাসি লেগে থাকার
মতো করে বাঁকানো। লুম্বা
ছিল লম্বাটে গড়নের, অনেকটা গাছের মতো। তার শরীরটা
মসৃণ, নীলাভ-সবুজ রঙের, আর
তার মাথায় ছিল অসংখ্য ছোট
ছোট আলোর বিন্দু, যা
তার অনুভূতি অনুযায়ী জ্বলে উঠত আর নিভে
যেত।
কোজো আর লুম্বা, তারা
দুজনেই গ্লিপটন গ্রহে বাস করত। গ্লিপটন
একটি সবুজ, শান্ত গ্রহ, যেখানে সবাই প্রকৃতির সঙ্গে
সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করে।
তারা সেখানে বিজ্ঞানী ছিল এবং মহাকাশযান
'আলোকম্ভীর'-এ করে নতুন
নক্ষত্রমণ্ডলী দেখতে বেরিয়েছিল। কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত উল্কাপাতের
কারণে তাদের মহাকাশযানটি পথ হারিয়ে পৃথিবীর
বুকে এসে পড়ে।
পৃথিবীতে আসার পর থেকেই
তারা নিজেদের বাড়ি ফেরার পথ
খুঁজছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পৃথিবীর মানুষের
ভাষা তারা বোঝে না,
আর তাদের মহাকাশযানটিও মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
কোজো ছিল দলের মধ্যে
বেশি মিশুকে। সে গ্রামের আশেপাশে
ঘুরে ঘুরে দেখত, চেষ্টা
করত মানুষের সঙ্গে ভাব জমানোর। কিন্তু
তার অদ্ভুত চেহারা দেখে গ্রামের মানুষ
ভয় পেয়ে যেত। কেউ
তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ত,
আবার কেউ লাঠি নিয়ে
তাড়া করত। লুম্বা সাধারণত
মন্দিরের পেছনেই থাকত। পৃথিবীর পরিবেশ তার শরীরের সঙ্গে
মানানসই ছিল না, তাই
দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।
একদিন, কোজো গ্রামের পাশে
একটি ছোট নদীর ধারে
ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানে সে দেখল একটি
ছোট মেয়ে কাঁদছে। মেয়েটির
নাম ছিল তারা। কোজো
তার কাছে গিয়ে জানতে
পারল, তারা তার প্রিয়
পুতুলটি হারিয়ে ফেলেছে। কোজো তখন তার
নিজের গ্রহের কথা ভাবল, যেখানে
সবাই সবার কষ্টে সহানুভূতি
জানায়। সে তার নরম
লোমশ হাত দিয়ে তারার
চোখের জল মুছিয়ে দিল,
আর ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল যে সে
পুতুল খুঁজে দেবে।
তারা প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু
কোজোর চোখে কোনও হিংসা
দেখতে না পেয়ে সে
একটু ভরসা পেল। কোজো
নদীর ধারে কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি
করার পর একটা ঝোপের
মধ্যে পুতুলটি খুঁজে পেল। তারা আনন্দে
কোজোর गले জড়িয়ে ধরল।
সেই প্রথম, কেউ কোজোকে ভয়
না পেয়ে বন্ধু হিসেবে
গ্রহণ করল।
তারার মা, রূপা, একজন
স্কুল শিক্ষিকা। তিনি যখন জানতে
পারলেন যে তারা একটি
অদ্ভুত প্রাণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে, তখন তিনি প্রথমে
ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু তারার মুখে কোজোর গল্প
শুনে তার মনে কৌতূহল
জন্মাল। তিনি তারাকে নিয়ে
মন্দিরের কাছে গেলেন।
রূপা দেখলেন, কোজো আর লুম্বা
দুজনেই খুব অসহায়ভাবে তাদের
দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা তাদের
ভাষা বুঝতেন না, কিন্তু তিনি
বুঝতে পারলেন যে তারা বিপদে
পড়েছে এবং সাহায্য চাইছে।
তিনি তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
রূপার বাড়িতে, কোজো আর লুম্বা
একটু স্বস্তি পেল। রূপা তাদের
খাবার দিলেন, তাদের থাকার জন্য একটা ঘর
ঠিক করে দিলেন। তিনি
বুঝতে পারলেন যে লুম্বা অসুস্থ,
তাই তিনি একজন পশু
চিকিৎসককে ডেকে পাঠালেন। পশু
চিকিৎসক লুম্বাকে পরীক্ষা করে জানালেন যে
পৃথিবীর আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার
কারণে লুম্বা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি
লুম্বাকে কিছু ওষুধ দিলেন
এবং বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ
দিলেন।
রূপা ছিলেন একজন বুদ্ধিমতী মহিলা।
তিনি কোজো আর লুম্বার
সঙ্গে কথা বলার জন্য
ছবি ব্যবহার করতেন। তিনি তাদের ছবি
এঁকে বোঝাতেন যে তারা কোথা
থেকে এসেছে, কেন এসেছে, এবং
তারা কী চায়। ধীরে
ধীরে, রূপা কোজো আর
লুম্বার ভাষা কিছুটা বুঝতে
পারলেন।
কোজো রূপাকে জানালো যে তাদের মহাকাশযানটি
খারাপ হয়ে গেছে এবং
তাদের বাড়ি ফেরার কোনও
উপায় নেই। রূপা বুঝতে
পারলেন যে তাদের সাহায্য
করার জন্য তাকে বিজ্ঞানীদের
সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তিনি
তার এক বন্ধু, যিনি
একজন বিজ্ঞানী, ডক্টর রাকেশ শর্মাকে সব কথা খুলে
বললেন।
ডক্টর রাকেশ প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি, কিন্তু
রূপা যখন তাকে কোজো
আর লুম্বার ছবি দেখালেন, তখন
তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তিনি
রূপার গ্রামে এসে কোজো আর
লুম্বার সঙ্গে দেখা করলেন। ডক্টর
রাকেশ তাদের পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন
যে তারা সত্যিই অন্য
গ্রহের প্রাণী।
ডক্টর রাকেশ কোজো আর লুম্বাকে
তাদের মহাকাশযান মেরামত করতে সাহায্য করার
সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার বিজ্ঞানীদের
একটি দল নিয়ে এলেন
এবং তারা সবাই মিলে
মহাকাশযানটি মেরামতের কাজ শুরু করলেন।
কিন্তু মহাকাশযানের যন্ত্রাংশ পৃথিবীর প্রযুক্তির থেকে অনেক আলাদা
ছিল, তাই মেরামত করতে
অনেক সমস্যা হচ্ছিল।
কোজো আর লুম্বা তাদের
প্রযুক্তি সম্পর্কে ডক্টর রাকেশকে বোঝানোর চেষ্টা করল। তারা ছবি
এঁকে, ইশারা করে তাদের যন্ত্রপাতির
গঠন বোঝালো। ডক্টর রাকেশ এবং তার দল
তাদের কথা মন দিয়ে
শুনে সেই অনুযায়ী কাজ
করতে লাগলেন।
দিনের পর দিন, রাতের
পর রাত ধরে কাজ
চলল। অবশেষে, অনেক চেষ্টার পর
মহাকাশযানটি মেরামত করা সম্ভব হলো।
কোজো আর লুম্বার চোখে
আনন্দ অশ্রু দেখা দিল। তারা
রূপা এবং ডক্টর রাকেশকে
জড়িয়ে ধরে তাদের প্রতি
কৃতজ্ঞতা জানালো।
বিদায় জানানোর সময়, গ্রামের সবাই
কোজো আর লুম্বাকে দেখতে
এসেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল
যে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী হলেও, তাদের মধ্যেও ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের অনুভূতি
রয়েছে। তারা কোজো আর
লুম্বাকে ফুল, ফল আর
মিষ্টি দিয়ে বিদায় জানালো।
কোজো আর লুম্বা 'আলোকম্ভীর'-এ চড়ে তাদের
গ্রহের দিকে রওনা হলো।
যাওয়ার আগে, কোজো তার
সোনালী চোখ দিয়ে রূপা
আর তারার দিকে তাকিয়ে হাসল।
লুম্বার মাথার আলো গুলো একবার
জ্বলে নিভে তাদের বিদায়
জানালো।
রূপা আর তারা আকাশের
দিকে তাকিয়ে দেখল, 'আলোকম্ভীর' ধীরে ধীরে ছোট
হয়ে যাচ্ছে, তারপর একসময় তারাদের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তারা জানত,
কোজো আর লুম্বা তাদের
গ্রহে ফিরে গেছে, কিন্তু
তাদের বন্ধুত্ব পৃথিবীর বুকে এক নতুন
ইতিহাস তৈরি করে দিয়ে
গেছে।
কোজো আর লুম্বা নিরাপদে
গ্লিপটন গ্রহে ফিরে আসে। তারা
তাদের গ্রহে পৃথিবীর মানুষের কথা জানায়। তারা
বলে যে পৃথিবীর মানুষ
প্রথমে তাদের দেখে ভয় পেলেও,
পরে তাদের আপন করে নিয়েছে।
তারা রূপা, তারা আর ডক্টর
রাকেশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ
করে।
তাদের কথা শুনে গ্লিপটন
গ্রহের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা
সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা
পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করবে। এরপর, গ্লিপটন গ্রহের একটি দল পৃথিবীর
সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দুই
গ্রহের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার এক
নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
রূপা তার স্কুলে কোজো
আর লুম্বার গল্প শোনায়। তারা
তাদের বন্ধুত্বের কথা জানতে পেরে
খুব উৎসাহিত হয়। তারা বুঝতে
পারে যে ভিন্নতা থাকা
সত্ত্বেও, ভালোবাসা আর সহানুভূতি দিয়ে
সব বাধা অতিক্রম করা
সম্ভব।
তারা বড় হয়ে একজন
বিজ্ঞানী হয় এবং গ্লিপটন
গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে
সবসময় কোজো আর লুম্বার
কথা মনে রাখে এবং
তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে
কাজ করে যায়।
এইভাবেই, কোজো আর লুম্বার
পৃথিবীতে আসা এবং তাদের
বাড়ি ফেরার পথ খোঁজার গল্পটি
বন্ধুত্ব, সহানুভূতি আর ভালোবাসার এক
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। এই
গল্পটি আমাদের শেখায় যে, যদিও আমরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ, ভিন্ন ভাষায় কথা বলি, তবুও
আমরা একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি এবং একে অপরকে সাহায্য করতে পারি।