নিশুতি রাতে শশ্মানের শাপ
নিশুতি রাতে শশ্মানের শাপ
তখন আমি
একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। একদিন আমার খালার বাড়ি
থেকে ফিরছি আমি আর আমার ফুফাত ভাই কামাল। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। নির্জন
গ্রাম্য পথ, আশেপাশে দু-একটা
বাড়ির নিভু নিভু আলো ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে শুধু
ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক আর আমাদের জীর্ণ চপ্পলের ঘষটানি।
ফেরার পথে
একটি খাল পাড় হতে হয়। শীতের শুরু, তবে খালে তখনো হাঁটু
পানি। মূল ঘাটটা একটু দূরে, প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। কামাল, যেমনটা সে বরাবরই ছন্নছাড়া আর বেপরোয়া, হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে খালের দিকে ইশারা করে বলল, "চল,
সোজা পাড় হয়ে যাই।"
আমি চমকে
উঠলাম। "সোজা? তাহলে তো শশ্মানে
গিয়ে উঠবো! আজই তো যতি কাকাকে দাহ করেছে ওখানে। জানিস তো, যতি কাকা হলো আমাদেরই বন্ধু মঙ্গলের বাবা।"
যতি কাকা
ছিলেন অসম্ভব ভালো মানুষ। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসতো। তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে শোকের
ছায়া নেমে এসেছিল গোটা গ্রামে। আজ সকালেই তাঁর শেষ কাজ সম্পন্ন হয়েছে শশ্মানে। সেই
শশ্মানঘাটে রাতের বেলা পা রাখা... এ চিন্তাতেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো।
কামাল আমার
দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসলো। ওর চোখে ভয় তো দূরের কথা, যেন এক ধরনের কৌতূহল খেলে যাচ্ছে। "ভালো কথা মনে
করেছিস! যতি কাকা আমাদের কত স্নেহ করতেন!
কোনো ভূত-প্রেত থাকলে তার আত্মাই তো আমাদের সাহায্য করবেন। চল, সোজা পাড় হয়ে যাই। অত
দূর ঘুরতে যাবো এই রাতে?"
ওর কথা শুনে
মেজাজ খারাপ হলেও কী আর করা! কামালকে বোঝানো মানে পাথরে মাথা ঠোকা। ওর যুক্তি শুনে
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। সদ্য দাহ করা এক মৃতদেহের দহনের
জায়গায় পা রাখতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না। তাও, ওর পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হলো। ওর কাছে সাহসী সাজার একটা বাজে বাতিক ছিল, আর আমি বরাবরই ওর এই বাতিকের শিকার হয়েছি।
আমরা খালের
জলে পা রাখলাম। রাতের বেলায় ঠান্ডা জল হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। সাবধানে পা ফেলে
এগোতে লাগলাম। জলের মধ্যে ঘাস-পাতা আর কাদায় পা পিছলে যাচ্ছিল বারবার। অন্ধকারে
কিছু ঠাহর হচ্ছিল না, শুধু চাঁদের ক্ষীণ
আলোতে জলের উপর একটা অস্পষ্ট পথরেখা দেখা যাচ্ছিল। মিনিট পাঁচেক পর, হাঁটু জল পেরিয়ে ধীর পায়েই আমরা ওপারে পৌঁছালাম।
এবং, যেমনটা আমি আশঙ্কা করেছিলাম, আমরা সরাসরি শশ্মান ঘাটে গিয়ে উঠলাম।
চারিদিকে
ছড়ানো ছিটানো ছাই, পোড়া কাঠ আর আধপোড়া
বাঁশ। বাতাসে এখনো পোড়া মাংসের আর চন্দনকাঠের একটা অদ্ভুত গন্ধ মিশে আছে।
বাঁশঝাড়ের আবছা ছায়া আর ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো শশ্মানকে আরও ভৌতিক করে
তুলেছে। পূর্ণিমার পরের রাত, তাই চাঁদের আলো বেশ
উজ্জ্বল। সেই আলোয় চারিদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শশ্মানের এক কোণে, যেখানে এখনো দহনের আগুন প্রায় নেভা নেভা, সেখানে পড়ে ছিল একটি আধপোড়া বাঁশ আর একটি মাটির হাঁড়ি।
সম্ভবত যতি কাকারই চিতা থেকে ফেলে রাখা সরঞ্জাম।
কামাল
সেগুলো দেখে চোখ পিটপিট করলো। ওর চোখে এক অদ্ভুত জেদ। "ঐ দেখ! একটা বাঁশ আর
একটা হাঁড়ি! চল, ওগুলো নিয়ে নিই।"
আমার বুকের
ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। "এগুলো নিয়ে কি করবি? কার জিনিস কে জানে, আবার অশুভ কিছু না
হয়!"
কামাল
হাসলো। ওর হাসিটা যেন এই শশ্মানের নিস্তব্ধতাকে আরও বিদ্রূপ করছিল। "শুনিসনি, শশ্মানের জিনিস
নিলে নাকি ভূত-প্রেত এসে বাধা দেয়? আমি কখনো ভূত দেখিনি; আজ দেখতে চাই। তুই
বাঁশটা নে, আমি হাঁড়িটা নিই।"
ওর কথা শুনে
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ভূত দেখার এমন পাগলামি কেউ করতে পারে! আমি ইতস্তত
করছিলাম। কিন্তু কামাল ততক্ষণে হাঁড়িটা তুলে নিয়েছে। ওর হাতে হাঁড়ি, আর আমার হাতে লম্বা, নোংরা, পোড়া বাঁশ। বাঁশটার একপাশটা এখনো
ছাই-ছাই হয়ে আছে, পোড়া গন্ধটা নাকে
এসে লাগছে। আমার গা গুলিয়ে উঠলো। এ যেন শশ্মানেরই এক অংশকে নিজেদের সাথে করে নিয়ে
চলেছি।
"তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, কামাল?" আমি ফিসফিস করে বললাম।
"দূর বোকা! চল, দেখি কী হয়!"
ও নির্বিকারভাবে এগিয়ে চললো।
যেই কথা সেই
কাজ। বাঁশ আর হাঁড়ি নিয়ে আমরা শশ্মান থেকে বের হতে শুরু করলাম। শশ্মানের সীমানা
পেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় পা রাখতে আমার বুকটা একটু হালকা হলো। যাক বাবা, শশ্মান পার হওয়া গেল! এবার শুধু সোজা পথটুকু।
কিন্তু সেই
স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
শশ্মান পাড়
হওয়ার পরপরই স্পষ্ট একটি পুরুষ কণ্ঠের কান্নার শব্দ আমার কানে এলো। প্রথমে ভাবলাম
পাশের বাড়ির কেউ হয়তো কাঁদছে। গ্রামের প্রথা অনুযায়ী, রাতেও শোকের মাতম ওঠে। কিন্তু শব্দটা একটু ভিন্ন লাগছিল।
কেমন যেন গোঙানির মতো, চাপা কিন্তু তীব্র।
আমি কামালের
দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে চেয়ে বলল, "শুনলি?"
আমি মাথা
নাড়লাম। আমরা এগোচ্ছি, আর কান্নার শব্দটা
মনে হলো আমাদের পিছনে পিছনেই আসছে। প্রথমে খুব ক্ষীণ, তারপর ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে একবার পিছনে তাকালাম, কিন্তু ঘন অন্ধকার আর বাঁশঝাড়ের সারি ছাড়া আর কিছুই চোখে
পড়লো না।
"চল,
দ্রুত পা চালাই," আমি বললাম, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।
আমরা গতি
বাড়ালাম। কিন্তু কান্নার শব্দটাও যেন আমাদের গতির সাথে তাল মিলিয়ে আরও দ্রুত আর
জোরদার হলো। মনে হচ্ছিল, কেউ একজন আমাদের
ঠিক পিছনেই হাঁটছে আর কাঁদছে। একটা চাপা গোঙানি, যেন কষ্ট আর যন্ত্রনায় ছটফট করছে কেউ।
আমি ভয়ে ভয়ে
আবার থামলাম। কামালও থামলো। আর আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের থামার সাথে সাথেই কান্নার শব্দটাও একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে আবার
সেই নিশ্ছিদ্র নীরবতা। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচার
ডাক।
আমার হাত-পা
ঠান্ডা হয়ে আসছিল। "কামাল, এটা কী হচ্ছে?" আমি ফিসফিস করে বললাম, "এটা কোনো বাড়ি থেকে আসা শব্দ নয়। এটা
আমাদের পিছন থেকে আসছে।"
কামালও এবার
একটু গম্ভীর হলো। ওর মুখের সেই বেপরোয়া হাসিটা উধাও। সে বাঁশ-হাঁড়িগুলোর দিকে
তাকালো,
তারপর আমার দিকে। "হুমম... কাকা বোধহয় আমাদের সাথে
হাঁটছেন।" ওর গলায় এবার আর কৌতুক নেই, কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা।
আমি শিউরে
উঠলাম। "যতি কাকা? কিন্তু তিনি তো...
তিনি কেন কাঁদবেন?"
সে কোনো
জবাব দিল না। আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আর আশ্চর্য, আবার সেই কান্নার শব্দ শুরু হলো। প্রথমে ক্ষীণ, তারপর দ্রুতই তীব্র হলো। এবার কান্নার সাথে একটা
দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মিশেছিল। যেন কেউ গভীর কষ্ট থেকে মুক্তি চাইছে।
পথটা
আঁকাবাঁকা। দু'পাশে ক্ষেত, আর কিছু দূরে দূরে ছোট ছোট বাড়ি। মাঝেমধ্যে ঝোপঝাড় আর বড়
গাছ। চাঁদের আলোতে গাছগুলোর ছায়াগুলো দানবের মতো দেখাচ্ছিল। আমার হাতে থাকা বাঁশটা
যেন নিজের থেকেই আরও ভারী লাগছিল। মনে হচ্ছিল, তার থেকে একটা শীতল শক্তি আমার হাতে ঢুকছে। আর কামালের হাতে থাকা হাঁড়িটা
থেকেও একটা অদ্ভুত শব্দ আসছিল, যেন ভিতরের কিছু
নড়াচড়া করছে।
"কামাল, মনে হয় এগুলো নেওয়া আমাদের ভুল হয়েছে," আমি বললাম, আমার গলা কাঁপছে।
"এখন আর কিছু করার নেই," সে নিচু গলায় বললো।
"ফেলে দিলে কী হবে কে জানে! হয়তো আরও বিপদে পড়বো।"
এইবার
কান্নার স্বরটা আরও নিকটে আসলো। এত কাছে, যেন আমাদের কানের কাছেই কেউ কাঁদছে। এবার আর শুধু কান্না নয়, কেমন যেন একটা চাপা কোঁকানোর শব্দ। মনে হচ্ছিল, শব্দটা আমাদের চারপাশ থেকে আসছে, চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরছে আমাদের। বাতাস যেন ভারী হয়ে গেছে। একটা পচা গন্ধ নাকে
এসে লাগলো – পোড়া মাংস আর ভেজা মাটির মিশ্র গন্ধ, যা শশ্মানের কাছে পেয়েছিলাম।
আমি আর
কামাল একে অপরের হাত শক্ত করে ধরলাম। আমরা প্রায় দৌড়াচ্ছিলাম বলা চলে। কিন্তু যতই গতি বাড়াই না কেন, সেই অদৃশ্য সত্তাটা যেন আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে।
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমার ঘাড়ে কেউ যেন
শীতল একটা নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ করেই, কামাল আর্তনাদ করে উঠলো। ওর হাত থেকে মাটির হাঁড়িটা ফসকে
মাটিতে পড়ে গেল। একটা ঠুস করে আওয়াজ হলো, আর হাঁড়িটা কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। সাথে সাথেই কান্নার শব্দটাও এক ঝটকায়
তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠলো। সেটা আর কান্নার মতো ছিল না, যেন একটা ভয়াবহ, মর্মভেদী চিৎকার। একটা অমানুষিক আওয়াজ। মনে হলো, আমাদের চারপাশের বাতাস যেন সেই চিৎকারে কাঁপছে।
"কী হলো, কামাল?" আমি ভয়ে সিটিয়ে গেলাম।
"আমার হাত... হাতটা... কেউ যেন চেপে ধরেছিল!" কামাল হাঁপাচ্ছে। তার
চোখগুলো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেছে।
ভাঙা
হাঁড়িটার টুকরোগুলো থেকে একটা ঘন সাদা ধোঁয়া উঠে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। ধোঁয়াটা
দেখে আমার মনে হলো, যেন তার মধ্যে একটা
অবয়ব ফুটে উঠছে – অস্পষ্ট, জট পাকানো, কষ্টমাখা। ধোঁয়ার গন্ধটা ছিল আরও তীব্র – পোড়া মানবদেহের
গন্ধ,
যা আগে কখনো এত কাছ থেকে অনুভব করিনি।
আর সেই
মুহূর্তেই, চিতার গন্ধ ছাপিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ
পেলাম,
যেন চন্দন আর শিউলি ফুলের গন্ধ। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেই
গন্ধ কেমন যেন আরও ভয়ের সৃষ্টি করলো। এটা কি যতি কাকার গন্ধ?
বাঁশটা আমার
হাতে তখন একটি লৌহ দন্ডের মতো ভারী মনে
হচ্ছে। আমার মনে হলো, এই বাঁশটা ধরে
রাখার জন্যই যেন সেই সত্তাটা আমাদের পিছনে লেগেছে। এটা যেন কোনো ফাঁদ ছিল, যা আমরা নিজেদের অজান্তেই ব্যবহার করেছি। আমি বাঁশটা ছুড়ে
ফেলে দিতে চাইলাম, কিন্তু হাতটা যেন
অসাড় হয়ে গেছে। পারছিলাম না।
চিৎকারটা
থামলো না। ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। মনে হলো, শত শত কণ্ঠ একসাথে চিৎকার করছে। এবার সেই চিৎকারের মাঝে মাঝে চাপা গোঙানি আর
অনুরোধ ভেসে আসতে লাগলো, "ফিরিয়ে দে... ফিরিয়ে দে..."
"কী ফিরিয়ে দেবো?" আমি প্রায় কেঁদে
ফেললাম।
সেই অস্পষ্ট
ধোঁয়াটে অবয়বটা যেন আরেকটু ঘন হলো। মনে হলো, একটা আকৃতির মতো সামনে এগিয়ে আসছে। দীর্ঘাকৃতির, শীর্ণ। চোখগুলো যেন জ্বলন্ত কয়লার মতো। আমার হৃদপিণ্ড তখন তীব্র গতিতে ছুটছে।
আমার মনে হলো আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারবো না।
"কামাল! দৌড়া!" আমি চিৎকার করে উঠলাম।
আমরা
প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করলাম। আমার হাতে সেই পোড়া বাঁশটা তখনো ধরা। বাঁশটা যেন আমার হাতকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এর মধ্যে একটা জীবন্ত শক্তি আটকে আছে। পায়ের নিচে মাটি মনে
হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল কোনো নরম কাদা।
পিছন থেকে
একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া ছুটে এলো, যেন কেউ আমাদের
পিছন থেকে টেনে ধরতে চাইছে। আমরা হোঁচট খেলাম, প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কান্নার শব্দটা এখন আর চিৎকারে নেই, যেন একটা হিসহিস শব্দ, ক্রোধে ফুঁসে ওঠা সাপের মতো।
আমরা গ্রামে
ঢোকার মুখে তখন। দূরে দেখা যাচ্ছে দু-একটা বাড়ির আলো। সেই আলো দেখে আমাদের বুকে
যেন নতুন করে সাহস সঞ্চার হলো। কিন্তু সেই সাহসও ধোপে টিকলো না। হঠাৎ করেই কামালের
পা কেউ যেন টেনে ধরলো। কামাল ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
"আহহহ!" সে যন্ত্রণায় চিৎকার করলো।
আমি ফিরে
দেখলাম। অন্ধকারে কিছু স্পষ্ট না হলেও, মনে হলো কামালের পায়ের কাছে একটা দীর্ঘ, কালো ছায়া নড়াচড়া করছে। সেই ছায়াটা যেন ধীরে ধীরে কামালের দিকে উঠে আসছে।
আমার হাতে
থাকা বাঁশটা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। হঠাৎ করেই একটা ঝলকানি দিয়ে উঠল বাঁশটা। আর
সেই ঝলকানির সাথে সাথেই বাঁশটা আমার হাত থেকে ছিটকে গেল। মাটিতে পড়ে ছটফট করতে
লাগলো। মনে হলো বাঁশের মধ্যে আটকে থাকা কোনো কিছু যেন মুক্তি চাইছে।
আর সেই
বাঁশটা ছিটকে পড়ার সাথে সাথেই, কামালের পা থেকে
সেই ছায়াটা সরে গেল। কামালের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা কালো রক্তের মতো কিছু তার পায়ের উপর লেগে আছে, আর সেই জায়গাটা থেকে ধোঁয়া উঠছে।
সেই
মুহূর্তে সেই হিসহিসে শব্দটা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠলো। মনে হলো, সেই অদৃশ্য সত্তা আমাদের উপর চরম প্রতিশোধ নিতে চাইছে। আমরা
দুজনেই উঠে পড়লাম, এবং প্রাণপণে ছুটতে
লাগলাম। আর পিছনে সেই অমানুষিক শব্দ। এবার মনে হল, কেউ যেন পাথর ছুড়ে মারছে আমাদের দিকে, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না।
আমরা ছুটতে
ছুটতে নিজেদের বাড়ির উঠোনে গিয়ে পৌঁছালাম। দরজা খোলা ছিল। আমরা নিঃশ্বাস নিতে
পারছিলাম না। বুকে তীব্র চিনচিনে ব্যথা। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি, আমাদের বাড়ির দিকে সেই কালো ছায়াটা এগিয়ে আসছে। ঠিক যেন
একটা বিশাল আকার, কালো ধোঁয়ার মতো।
আমার চোখ
দুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেল। কামাল আমাকে ধাক্কা মেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর
দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ
করতেই,
বাইরে থেকে একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এলো, যা শুনলে যেকোনো মানুষের রক্ত হিম হয়ে যাবে। সেই চিৎকারের
পর একটা চাপা গোঙানি আর দীর্ঘশ্বাস। এরপর সব নীরব।
আমরা দু’জনই
মাটিতে বসে পড়লাম। তখনও আমাদের শরীর কাঁপছিল। আমাদের মা-বাবা ছুটে এলেন, কিন্তু আমরা তাদের কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু ভয়ে
জুবুথুবু হয়ে বসেছিলাম।
রাতটা আমরা
কোনোমতে কাটালাম। পরের দিন সকালে আমরা বাইরে গিয়েছিলাম দেখতে, সেই বাঁশ বা হাঁড়ির কোনো চিহ্ন আছে কিনা। কিন্তু কোথাও কোনো
কিছু খুঁজে পেলাম না। এমনকি কামালের পায়ে যে কালো রক্তের মতো দাগ ছিল, সেটাও উধাও হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই
রাতের স্মৃতি আজও আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। যখনই রাত দশটা বাজে, আমাদের দু'জনেরই বুক ধড়ফড় করে
ওঠে। শশ্মানের পোড়া গন্ধ আমাদের নাকে এসে লাগে, আর কানের কাছে যেন সেই অমানুষিক চিৎকার আর গোঙানি শুনতে পাই।
আমরা কখনোই
জানতে পারিনি, সেই রাতে কে আমাদের পিছু নিয়েছিল।
যতি কাকার আত্মা? নাকি শশ্মানেরই
কোনো অশুভ শক্তি, যা সেই বাঁশ আর
হাঁড়ির মধ্যে লুকিয়ে ছিল? কামাল তার সেই ভূত
দেখার কৌতূহল জীবনে দ্বিতীয়বার দেখায়নি। আর আমি? সেই রাতের পর থেকে যখনই কোনো অন্ধকারের নির্জন পথে হাঁটি, আমার মনে হয় আজও কেউ যেন আমার ঠিক পিছন পিছন হেঁটে চলেছে, আর মাঝে মাঝে চাপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলছে, "ফিরিয়ে দে... ফিরিয়ে
দে..."। সেই রাতে শশ্মানের সেই জিনিস দুটো নেওয়ার ভুলটা আজও আমাদের পিছু ছাড়ে
না। আর সেই কান্নার শব্দ আজও কোনো কোনো নিঝুম রাতে আমাকে ঘুমোতে দেয় না।