অশোকনগরের অভিশপ্ত বাড়ি
অশোকনগরেরঅভিশপ্ত বাড়ি
অশোকনগর।
বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম।
তিন হাজার মানুষের বসতি এখানে, যারা
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে
এই মাটির গন্ধ, এই বাঁশের ঝোপ,
আর পিয়াল বনের ছায়ায় বড়
হয়েছে। এখানকার জীবন ধুলো মাখা
পথের মতোই সরল, সকালের
সূর্যালোক আর গোধূলির নরম
কমলা রঙে রাঙানো। কিন্তু
এই সরলতার আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর
আতঙ্ক, এক প্রাচীন রহস্য
– গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পরিত্যক্ত
ইঁটের পিজরা, যেটাকে গ্রামের মানুষ ‘ভূতের বাড়ি’ বলে ডাকে।
কেউ
জানে না বাড়িটা ঠিক
কত শতকের পুরোনো। কত প্রজন্ম ধরে
গ্রামের মানুষেরা বাড়িটিকে দেখে আসছে, তার
জীর্ণ দেয়ালগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলা, লতাপাতায় ঢাকা তার শরীর,
ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে যেন
অন্ধকার উঁকি মারে। গ্রামের
প্রবীণতম ব্যক্তিটিও এই বাড়ির অতীত
সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা
দিতে পারেন না, শুধু এটুকুই
জানেন যে এই বাড়িতে
প্রবেশ করা মানেই নিশ্চিত
মৃত্যু অথবা চিরস্থায়ী উন্মাদনা।
এ বাড়ির দেওয়াল জুড়ে নাকি লেগে আছে
এক অশুভ শক্তির ছাপ,
আর প্রতি পূর্ণিমার রাতে এখান থেকে
ভেসে আসে চাপা কান্নার
আওয়াজ, কখনো বা অশরীরী
হাসির গমগমে শব্দ। এই লোকগাথা এতটাই
গভীরে গেঁথে গেছে যে, দিনের
বেলাতেও কেউ এই বাড়ির
কাছাকাছি আসার সাহস করে
না, আর সন্ধ্যা নামলে
তো কথাই নেই।
কিন্তু
আধুনিকতার ছোঁয়ায় যখন গ্রামের প্রথাগত
বিশ্বাসে ভাঙন ধরে, তখন
কিছু মানুষের কাছে এই অলৌকিক
গল্পগুলো কেবলই মজাদার উপকথা মনে হয়। এমনই
একদল তরুণ-তরুণী এলো
ঢাকা থেকে। শহুরে কোলাহল আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিড়ে
বেড়ে ওঠা এই পাঁচজন
যুবক-যুবতী – রাহাত, নিশা, কবির, ইমরান ও রুমি। তাদের
উদ্দেশ্য ছিল অজানা ইতিহাস
আর রোমাঞ্চের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া। সোশ্যাল মিডিয়ার
যুগে তারা ভ্লগিং করে,
আর তাদের এবারের লক্ষ্য অশোকনগরের এই অভিশপ্ত বাড়ি।
তাদের মনে ছিল না
কোনো ভয়, ছিল কেবলই
এক দুর্নিবার কৌতূহল আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা।
রাহাত
ছিল দলের নেতা, সাহসী
ও যুক্তিবাদী। নিশা, দলের একমাত্র মেয়ে,
কিছুটা ভীতু হলেও কৌতুহল
তার সবচেয়ে বেশি। কবির, গল্পকার, যে বিশ্বাস করে
ভূতের গল্পে, কিন্তু সাহস করে না।
ইমরান, যে সবসময় মজা
করে, সবকিছুকে হালকা ভাবে নেয়। আর
রুমি, যে তার ক্যামেরা
দিয়ে সব কিছু রেকর্ড
করে, দলের ডকুমেন্টারি বানানোই
তার কাজ।
অশোকনগরে
পৌঁছানোর পর গ্রামবাসীর চোখে
ছিল এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
কৌতূহল, সন্দেহ এবং এক ধরনের
চাপা ভয়। যখন তারা
ভূতের বাড়ির দিকে যাওয়ার আগ্রহ
প্রকাশ করল, তখন গ্রামের
প্রবীণ মাতব্বর, হাতে লম্বা লাঠি
নিয়ে, গম্ভীর মুখে তাদের দিকে
তাকিয়েছিলেন। “বাবারা, ওই বাড়ি সইত্যি
অভিশপ্ত। ওইখানে যারা গেছে, তারা
আর ফিরে আসেনি। যে
গেছে, সে হয় মারা
গেছে, নয় পাগল হয়ে
ফিরেছে। তোমরা ফিরে যাও, শহরের
ছেলেমেয়ে, বিপদ ডেকে এনো
না।” প্রবীণ মূর্তির সেই সাবধানবাণী শুনে
রাহাত হাসল। “চাচা, আমরা বিজ্ঞান ও
যুক্তির ধারক। এসব কুসংস্কারের কোনো
মূল্য নেই। ভূত-প্রেত
কেবল মনের ভ্রম।” রাহাত
আর তার বন্ধুরা মাতব্বরের
কথাকে পাত্তাই দিল না। তাদের
চোখে ছিল নতুন এক
চ্যালেঞ্জ জেতার নেশা।
সূর্য
ডুবতে তখনও খানিকটা সময়
বাকি, কিন্তু গ্রামের দিকে সন্ধ্যা নামতে
শুরু করেছে। আবহাওয়াটা দ্রুতই ভারী হয়ে উঠলো।
পশ্চিমের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসছে।
তারা যখন বাড়ির সামনে
এসে দাঁড়াল, তখনো বাড়ির বিশালত্ব
আর নিস্তব্ধতা তাদের খানিকটা প্রভাবিত করল। বাড়িটা যেন
জীবন্ত এক দানব, তার
বিশাল দেহ নিয়ে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে, আর তার
ভাঙা জানালাগুলো যেন অসংখ্য মৃত
চোখ। প্রবেশ পথের কপাটগুলো অনেক
আগেই খসে পড়েছে, কেবল
চৌকাঠের কাঠামোটাই অবশিষ্ট।
রুমি
ক্যামেরা অন করে তার
ভ্লগ শুরু করল। “হাই
গাইস, আমরা এখন অশোকনগরের
সেই কুখ্যাত অভিশপ্ত বাড়ির সামনে। দেখতে পাচ্ছেন, বাড়িটা কতটা জীর্ণ আর
ছমছমে। গ্রামবাসীরা আমাদের সতর্ক করেছে, কিন্তু আমরা ভয় পাই
না। আমরা ভিতরে প্রবেশ
করতে চলেছি, এবং আপনাদের দেখাতে
চলেছি এর ভেতরের রহস্য!”
প্রথমেই
তারা প্রবেশ করল মূল বারান্দায়,
যা ধুলো ও শুকনো
পাতার স্তূপে ঢাকা। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ,
পুরনো ধুলো, পচা কাঠ আর
এক অজানা, অস্বস্তিকর ঘ্রাণ। ভেতরের অন্ধকার এতটাই গাঢ় ছিল যে,
তাদের টর্চের আলো সেই অন্ধকারকে
কেবল আরো রহস্যময় করে
তুলছিল। দেওয়ালজুড়ে শ্যাওলা আর ফাঙ্গাসের আস্তরণ,
আর মাথার উপরে ঝুলছিল মাকড়সার
বিশাল জাল।
প্রথম
কক্ষটা ছিল বিশাল একটা
বৈঠকখানা। ভাঙা আসবাবের টুকরো,
ছেঁড়া পর্দা আর একজোড়া পুরনো
জুতো পড়ে ছিল। রাহাত
এগিয়ে গিয়ে একটা কাঠের
চেয়ার উল্টে দিল। “দেখো, এখানে ভূত টুত কিছু
নেই। কেবলই পুরোনো একটা বাড়ি।” তাদের
কথাগুলো কক্ষের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে প্রতিধ্বনিত হয়ে
আবার ফিরে এল।
হঠাৎ
একটা ঠান্ডা স্রোত তাদের গা দিয়ে বয়ে
গেল। নিশা কাঁপা কাঁপা
গলায় বলল, “হঠাৎ এত ঠান্ডা
লাগলো কেন?” ইমরান হেসে বলল, “পুরনো
বাড়ির ঠান্ডা হাওয়া, আর কিছু না।
চল, ওপর তলায় যাই।”
কাঠের
সিঁড়িগুলো ভীষণ নড়বড়ে ছিল।
প্রতিটা পদক্ষেপে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছিল, যা
যেন তাদের হৃদস্পন্দনের শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছিল।
ওপরের তলায় ছিল কয়েকটি
শোবার ঘর। একটা ঘরে
তারা দেখতে পেল একটা পুরনো
ভাঙা বিছানা। বিছানার পাশে একটা ছোট
কাঠের টেবিল, তাতে একটা ভাঙা
কাঁচের গ্লাস আর একটা আধপোড়া
মোমবাতি।
তারা
যখন দ্বিতীয় তলার করিডোর দিয়ে
যাচ্ছিল, রুমি দেখল তার
ক্যামেরার স্ক্রিনে কিছু একটা ঝলসে
উঠলো। সে ফোকাস করার
আগেই সেটা মিলিয়ে গেল।
সে ভাবল, হয়তো ক্যামেরার ত্রুটি।
কিন্তু তার মনে একটা
খটকা থেকেই গেল।
একটু
পরেই ঘটনাগুলো বাড়তে শুরু করল। একটি
বন্ধ দরজা আপনা থেকেই
ক্যাঁচ করে খুলে গেল।
তাদের বুক ধড়ফড় করে
উঠলো। রাহাত টর্চ ফেলে দ্রুত
সেই ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরটি ছিল সম্পূর্ণ খালি,
কেবল মাঝখানে একটি ভাঙা কাঁচের
আয়না পড়ে ছিল। আয়নার
ভাঙা টুকরোগুলো অন্ধকারে চিকচিক করছিল। রাহাত বলল, “হয়তো বাতাসের ঝাপটায়!”
কিন্তু ঘরটা সম্পূর্ণ আবদ্ধ
ছিল।
কিছুক্ষণ
পরেই শুনতে পেল তারা ফিসফিস
শব্দ। মনে হচ্ছে যেন
কেউ তাদের নাম ধরে ডাকছে।
কবির ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে
রাহাতের হাত ধরল। “শুনলি?
কেউ যেন কথা বলছে!”
রাহাত বলল, “তোদের মনের ভুল। এখানে
কেউ নেই।” কিন্তু সে নিজেও কিছুটা
আতঙ্কিত হতে শুরু করেছিল।
আরেকটা
ঘরে প্রবেশ করে তারা দেখল,
টেবিলের উপর অনেকগুলো পুরনো
বই আর খাতা পড়ে
আছে। ধুলোর আস্তরণে ঢাকা, কিন্তু তাদের কভার থেকে অদ্ভুত
প্রতীক আর ছবি দেখা
যাচ্ছে। রাহাত ও নিশা কৌতূহলবশত
বইগুলো দেখতে শুরু করল। একটি
খাতা খুলতেই তারা দেখল, সেখানে
অদ্ভুত হস্তাক্ষরে কিছু লেখা আছে,
আর তার পাশে মানুষের
খুলি ও হাড়ের ছবি
আঁকা। নিশা ভয় পেয়ে
গেল। “এগুলো কী? মনে হচ্ছে
পুরনো কোনো তন্ত্র-মন্ত্রের
বই!”
হঠাৎ
সেই ঘর থেকে একটা
তীব্র দুর্গন্ধ আসতে শুরু করল,
পচা মাংসের মতো। তাদের গা
গুলিয়ে উঠল। রুমি আতঙ্কিত
চোখে রুমির দিকে তাকাল। তার
ক্যামেরা তখনো চলছিলো, কিন্তু
সে দেখল স্ক্রিনে তাদের
চারপাশে পাতলা সাদা ধোঁয়ার মতো
কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
ইমরান,
যে এতক্ষণ সবকিছুকে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে
উড়িয়ে দিচ্ছিল, সেও ভয়ে চুপসে
গেল। হঠাৎ তার মনে
হলো, তার কাঁধে যেন
ঠান্ডা কিছু একটা স্পর্শ
করল। সে চমকে পেছনে
তাকাল, কিন্তু কিছু দেখতে পেল
না। “কে রে?” তার
কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।
রাহাত
দেখল তার টর্চের আলো
হঠাৎ করে নিস্তেজ হয়ে
এল। সে ব্যাটারি চেক
করার চেষ্টা করল, কিন্তু দেখল
ব্যাটারিগুলো ঠিকই আছে। এই
সময়েই তারা শুনতে পেল,
নিচতলা থেকে একটা করুণ
আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে।
যেন কোনো শিশু কাঁদছে।
কবির
আর থাকতে পারল না। “আমরা
আর থাকব না। চল,
এখান থেকে বেরিয়ে যাই!”
সে প্রায় চিৎকার করে উঠল। রাহাত
নিজেও ভয় পেতে শুরু
করেছিল, কিন্তু সে মুখে কিছু
বলল না। “আর একটু
দেখি। হয়তো কোনো বাদুড়
বা শিয়াল হবে।”
তারা
যখন নিচ তলায় নামার
জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল,
দেখল সিঁড়ির মাঝখানে একটা ছায়া মূর্তি
দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তিটা সম্পূর্ণ
অন্ধকার, কোনো স্পষ্ট অবয়ব
নেই, কেবল একটি মানবাকৃতি।
নিশা ভয়ে চিৎকার করে
উঠলো। রুমি ক্যামেরা অন
করেই ছিল, কিন্তু তার
হাতে ক্যামেরা কাঁপছিল। সেই মূর্তিটা নড়াচড়া
করল না, কেবল তাদের
দিকে তাকিয়ে থাকল।
রাহাত
সাহসের সাথে এগিয়ে গেল।
“কে? কে ওখানে?” তার
কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। কিন্তু কোনো উত্তর এল
না। শুধু একটা চাপা
হাসির শব্দ ভেসে এল,
যা তাদের কানে সরাসরি প্রবেশ
করল, যেন কেউ তাদের
কানের কাছে এসে হাসছে।
এরপরই
শুরু হলো বিভ্রম। তাদের
মনে হতে লাগল, তারা
একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
পড়ছে। রাহাত দেখছিল নিশা তার দিকে
এক ভয়ানক হাসিতে তাকিয়ে আছে, তার চোখ
যেন জ্বলছে। নিশা দেখছিল রাহাত
একটা জীর্ণ বৃদ্ধের রূপ ধারণ করে
তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কবির দেখছিল, ইমরান তার দিকে একটা
ধারালো ছুরি তুলে ধরেছে।
রুমি দেখছিল তার ক্যামেরার স্ক্রিনে
শুধু সাদা নয়েজ, আর
সেই নয়েজের মধ্যে কিছু অস্পষ্ট মুখ
ভেসে উঠছে। তারা একে অপরকে
সন্দেহ করতে শুরু করল।
“এটা
তুমি করছো!” নিশা চিৎকার করে
উঠল রাহাতের দিকে। “আমি কিছু করিনি!”
রাহাতও পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল।
তারা
একে অপরের থেকে দূরে সরে
গেল, ভয়ে, বিভ্রমে। রুমি
দেখছিল তার ক্যামেরা হাত
থেকে পড়ে গেল, আর
তার স্ক্রিনে ভেসে উঠল অসংখ্য
মৃত মানুষের মুখ। সে বুঝতে
পারল, এটা কেবল মনের
খেলা নয়, বাড়ির অশুভ
শক্তি তাদের মানসিকতার উপর সরাসরি আঘাত
করছে।
হঠাৎ
করেই কবির চিৎকার করে
উঠল, “ওই দেখা যায়,
ওরা কারা!” সে এক অদৃশ্য
কিছুর দিকে তাকিয়ে ছিল,
তার চোখ বিস্ফারিত, মুখ
হাঁ হয়ে আছে। সে
দৌড়ে বাড়ির গভীরের এক অন্ধকার কক্ষের
দিকে চলে গেল। রাহাত,
নিশা ও ইমরান নিজেদের
বিভ্রম থেকে কিছুটা বেরিয়ে
এসে কবিরের পেছনে দৌড়াল।
কবির
সেই কক্ষের ভিতরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখ
ফ্যাকাশে। সে এক বিশালাকৃতির
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল,
যার উপর অস্পষ্টভাবে কিছু
ছবি আঁকা ছিল। ছবিগুলো
ছিল বিকৃত মানুষের মুখ, আর তার
পাশে অদ্ভুত কিছু প্রতীক। রাহাত
টর্চের আলো ফেলতেই দেখল,
ছবির নিচে পুরনো বাংলায়
লেখা কিছু শব্দ – ‘রুদ্র
প্রতাপ মন্ডল’, ‘জীবিত আত্মাদের মুক্তি নেই’, ‘রক্তের মন্ত্র’।
তারা
বুঝতে পারল, এই বাড়িটি এককালের
প্রভাবশালী জমিদার রুদ্র প্রতাপ মন্ডলের। সে ছিল একজন
তন্ত্র সাধক, যে নিষিদ্ধ জ্ঞান
এবং অশুভ শক্তি অর্জনের
জন্য নরবলি ও কালো যাদু
অনুশীলন করত। তার সেই
অশুভ শক্তিই এই বাড়িতে আটকা
পড়ে আছে, আর সেই
শক্তিই এই বাড়িকে অভিশপ্ত
করে রেখেছে। রুদ্র প্রতাপের আত্মাই এই বাড়ির প্রতিটি
ইঁটে মিশে আছে, এবং
যারা এখানে প্রবেশ করে, তাদের আত্মাকে
সে গ্রাস করে তার শক্তি
বৃদ্ধি করে।
হঠাৎ
করেই কক্ষের তাপমাত্রা কমে গেল, যেন
হাড় হিম করা ঠান্ডা
চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস ভারী
হয়ে উঠল, আর তাদের
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
ছাদের ভাঙা বিমগুলো থেকে
ফোঁটা ফোঁটা কালো জল ঝরতে
শুরু করল। এক ভয়ানক,
বিকৃত হাসি শোনা গেল,
যা তাদের স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি
করল।
তারাই
দেখল, সেই দেয়ালের মাঝখানে
একটা বিশাল অন্ধকার ছায়া ক্রমশ স্পষ্ট
হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে
একজন মানুষের রূপ নিচ্ছে। একজন
লম্বা, শীর্ণকায় বৃদ্ধ, যার চোখ দুটো
লালচে, আর পোশাকে লেগে
আছে রক্তের ছাপ। রুদ্র প্রতাপ
মন্ডলের সেই অশুভ আত্মা
তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
“তোমরা
এসেছ! আমার নতুন মেহমান!
এইবার তোমরা আমার শক্তির অংশ
হবে!” বিকৃত কণ্ঠস্বর।
ইমরান
চিৎকার করে উঠল, “পাগল
নাকি!” সে জ্ঞান হারানোর
উপক্রম। সেই অশরীরী শক্তি
হঠাৎ করে কবিরের দিকে
হাত বাড়াল। কবির যেন সম্মোহিত
হয়ে সেই হাতের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছিল। রাহাত ও নিশা চিৎকার
করে উঠল, “কবির, না!” কিন্তু ততক্ষণে
দেরি হয়ে গেছে। অশরীরী
মূর্তিটি কবিরকে তার নিজের দিকে
টেনে নিল, আর দেয়ালের
বুকে যেন একটা বিরাট
কালো গহ্বর তৈরি হলো, যার
মধ্যে কবির অদৃশ্য হয়ে
গেল। একটা আর্তনাদ শোনা
গেল, তারপরই সব শান্ত।
রাহাত,
নিশা ও ইমরান ভয়ে
প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল। রুমি
আগেই ভয় পেয়ে বাইরে
চলে গিয়েছিল। তারা পেছনে ফিরে
তাকানোরও সাহস পেল না।
তাদের পায়ের চাপে শুকনো পাতা
আর ধুলো উড়ছিল, আর
তাদের হৃদস্পন্দন যেন তাদের কানের
পর্দা ছিঁড়ে দিচ্ছিল। তারা অন্ধকার আর
নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে পাগলের মতো
দৌড়াচ্ছিল।
বাইরে
বেরিয়ে এসে তারা দেখল
রুমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। তাকে
কোনো রকমে টেনে তুলে
তারা গ্রামের দিকে দৌড়াতে লাগল।
তাদের পিছে সেই অভিশপ্ত
বাড়ির অশুভ উপস্থিতি যেন
তাড়া করে ফিরছিল। বাতাসের
শব্দ, গাছের পাতার খসখস – সব কিছুতেই তারা
সেই অশরীরী হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল।
তারা
যখন অশোকনগরের প্রথম ঘরের কাছে পৌঁছাল,
তখন তারা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত,
মুখে ধুলো আর চোখে
বিভীষিকা। গ্রামের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত।
মাতব্বর তাদের দিকে এগিয়ে এলেন,
তার চোখে ছিল হতাশা
আর আগেই অনুমান করা
এক দুঃখ। “তোমাদের না বারণ করেছিলাম,
বাবা? ওই বাড়ি শয়তানের
জায়গা। কি হয়েছে?”
রাহাত
হাঁপাচ্ছিল, মুখ দিয়ে কোনো
শব্দ বের হচ্ছিল না।
নিশা কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদছিল আর ইমরান মাটিতে
বসে পড়েছিল, তার চোখে ছিল
শূন্যতা। রুমি তখনো অচৈতন্য।
তারা শুধু বলতে পারল,
“কবির… কবির আর নেই…”
অশোকনগরের
সেই অভিশপ্ত বাড়ি আজও সেখানেই
দাঁড়িয়ে আছে, তার নীরব,
জীর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে। গ্রামের মানুষ জানে, আরও একটি আত্মা
সেই বাড়ির অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে গেছে। যারা ফিরে এসেছিল,
তারা আর কখনো আগের
মতো হতে পারেনি। তাদের
চোখের গভীরে রয়ে গেছে সেই
বাড়ির অন্ধকার, সেই অশুভ শক্তির
ছায়া। তারা জানে, অশোকনগরের
সেই ভূতের বাড়ি কেবল একটি
জীর্ণ কাঠামো নয়, বরং এক
জীবন্ত কবর, যেখানে রুদ্র
প্রতাপ মন্ডলের অশুভ আত্মা আজও
জীবিত আত্মাদের বন্দি করার অপেক্ষায় আছে।
আর প্রতি পূর্ণিমার রাতে, যখন চাঁদ ওঠে,
তখনো সেই বাড়ির নিস্তব্ধতা
ভেঙে ভেসে আসে এক
অশরীরী আর্তনাদ – কবিরের শেষ আর্তনাদ। এই
গল্প অশোকনগরের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে,
এক চিরন্তন সতর্কবাণী হয়ে, সেই অশুভ
বাড়ির বিরুদ্ধে।