রোজাবেল: যে গোলাপ ফোঁটার আগেই ঝরে গেল

রোজাবেল: যে গোলাপ ফোঁটার আগেই ঝরে গেল

রোজাবেল যে গোলাপ ফোঁটার আগেই ঝরে গেল

আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হাসান সাহেব। ধূসর মেঘে ঢাকা কাতারের আকাশ। এই আকাশ, এই মরুভূমি তাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করে না। তার সব স্বপ্ন, সব অনুভূতি জুড়ে আছে শুধু একটি মুখ – রাবেয়া। আর তাদের অনাগত সন্তান। দীর্ঘ ১১টি বছর, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত শুধু একটি সন্তানের জন্য হাহাকার করেছেন তারা। পৃথিবীর কোন উন্নত দেশ, কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে না দেখিয়েছেন? দিল্লি, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, লন্ডন – কোথায় না ছুটেছেন তারা? শত শত পরীক্ষা, হাজারো পরামর্শ, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের পর অবশেষে আশার আলো দেখা দেয়। টেস্টটিউব বেবির মাধ্যমে রাবেয়ার গর্ভে আসে তাদের বহু প্রতীক্ষিত সন্তান। সেই খবর শুনে হাসান সাহেব যেন শূন্যে ভাসছিলেন। তার মরুভূমির জীবনে যেন এক ঝলক মরূদ্যান খুঁজে পেয়েছিলেন।

রাবেয়ার গর্ভাবস্থা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন অলৌকিক ঘটনা। হাসান চেয়েছিলেন, তার সন্তান যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে, সেরা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয়। তাই বাংলাদেশের সব মায়া ছেড়ে তিনি রাবেয়াকে পাঠিয়ে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। নিউইয়র্কের সেই বিশাল আকাশচুম্বী হাসপাতালের নামকরা প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ড. এলিজাবেথ গ্রিন এবং তার দল দিনরাত রাবেয়ার দেখভাল করছিলেন। হাসান নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সব খরচের ভার, কারণ সন্তানের সুস্থ জন্ম তার কাছে সবকিছুর চেয়ে বড় ছিল। কাতার থেকে দিনে কয়েকবার ফোন করে রাবেয়ার খোঁজ নিতেন, ভিডিও কলে তার ফোলা পেটের দিকে তাকিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকতেন। এই সন্তানের জন্য তারা কী না করেছেন! কতো রকমের চেষ্টা, কতো প্রার্থনা! জীবনের সব সঞ্চয়, সব স্বপ্ন যেন এই ছোট্ট প্রাণটির দিকে তাকিয়ে ছিল

সেদিন ছিল এক অস্থির রাত। কাতারের ঘড়িতে তখন রাত ৮টা, আর নিউইয়র্কে তখন রাত ১১টা। হাসান নিজের অফিসে বসে শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ সারছিলেন। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাবেয়ার নার্স, লরার আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর। “মি. হাসান, একটা সমস্যা হয়েছে! মিসেস রাবেয়ার টেম্পারেচার আনইউজুয়ালি হাই হয়ে গেছে, উনি প্রায় অজ্ঞান। বাচ্চার হার্টবিট খুব অনিয়মিত… ডাক্তাররা ইমার্জেন্সি সিজারের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।”

হাসানের মাথার ভেতরটা দপদপ করে উঠলো। হাত থেকে ফোনটা ফসকে পড়ার উপক্রম হলো। সারা শরীর যেন বরফ হয়ে গেল তার। রাবেয়া অজ্ঞান? বাচ্চার হার্টবিট অনিয়মিত? দীর্ঘ ১১ বছরের সংগ্রাম, এতো দিনের স্বপ্ন, সব কি এক নিমিষে চূর্ণ হয়ে যাবে? তার মনে পড়লো, রাবেয়ার জীবনেও কোন ঝুঁকি নেই তো? এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে পাশে থাকতে না পারার অক্ষমতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। পৃথিবীটা যেন হঠাৎ থেমে গেল। তিনি অস্থিরভাবে অফিসের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে রাতের কাতার মরুভূমির শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হাসানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম

লরা এখনো ফোনে কথা বলছিল, “ডাক্তার গ্রিন বলছেন, সময় খুব কম। আপনার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।” সিদ্ধান্ত? কীসের সিদ্ধান্ত? জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা? হাসান কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “প্লিজ, সবার আগে রাবেয়াকে বাঁচান। তারপর আমার সন্তান।” তার কণ্ঠস্বর বুজে আসছিল। তিনি শুনলেন, ফোনের ওপাশ থেকে মৃদু চিৎকারের শব্দ আসছে। অস্পষ্ট, অগোছালো। “বাঁচাও… প্লিজ… আমার বাচ্চাটিকে বাঁচাও… প্লিজ, ডাক্তার… প্লিজ…”

এ কি রাবেয়া? জ্ঞান হারানোর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও সে তার সন্তানের জন্য আকুতি জানাচ্ছে? এই চিৎকার যেন হাসানকে হাজার টুকরো করে দিল। নিজের স্ত্রীর এমন অসহায়ত্ব দেখেও কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। তিনি শুধু বলতে পারলেন, “যা করা দরকার, দ্রুত করুন। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।” এরপর ফোন কেটে গেল। হাসান চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। তার দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো নোনা জল। এ কান্নার কোনো ভাষা ছিল না। শুধু ভয় আর অসহায়ত্ব

পরের দুটো ঘণ্টা হাসানের কাছে মনে হলো অনন্তকাল। তিনি শুধু আল্লাহর নাম জপছিলেন। প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক একটা যুগ। বারবার ফোন ধরার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ডায়াল করার সাহস পাচ্ছিলেন না। অবশেষে, ভোরের আলো ফোটার আগে, আবারও লরার ফোন। এইবার কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ থাকলেও, এক ধরনের স্বস্তি ছিল। “মি. হাসান, মাশাআল্লাহ! আপনার মেয়ে হয়েছে! মিসেস রাবেয়াও সুস্থ আছেন, তবে বেশ দুর্বল।”

হাসান বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মেয়ে? সুস্থ? রাবেয়াও সুস্থ? তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, চোখ দিয়ে আবারও জল গড়িয়ে পড়লো, তবে এবার আনন্দের। ১১ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে এলো তাদের রাজকন্যা। হাসান ছুটে গেলেন বিমানবন্দরের দিকে। প্রথম ফ্লাইটে নিউইয়র্ক পৌঁছাতে হবে

হাসপাতালের করিডোরে ডক্টর গ্রিনকে দেখে তিনি কৃতজ্ঞতায় হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ডক্টর গ্রিন হাসিমুখে বললেন, “আপনার স্ত্রী অসম্ভব ধৈর্যশীল আর সাহসী। এবং আপনার মেয়ে, সে একজন যোদ্ধা!” এরপর তিনি রাবেয়ার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাবেয়া তখনো নিস্তেজ, কিন্তু তার চোখে এক অপার্থিব দীপ্তি। পাশে একটি কাঁচের ইনকিউবেটরে গোলাপী রঙের ছোট্ট একটি প্রাণ ঘুমিয়ে আছে। হাসান এগিয়ে গেলেন, ছোট্ট হাতটিতে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন। এই নিষ্পাপ মুখটি তাদের সব অপেক্ষার, সব কষ্টের ফল। হাসান আর রাবেয়া একসঙ্গে নাম রাখলেন – রোজাবেল। তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপ

রোজাবেল ছিল হাসান আর রাবেয়ার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। তার এক ঝলক হাসি তাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিত। তার ছোট ছোট পায়ের পদক্ষেপ ছিল তাদের জীবনের ছন্দ। রোজাবেলের হাঁটাচলা, তার কথা বলা শেখা, তার প্রথম ‘বাবা’ ডাক – সবকিছুই যেন একেকটি উৎসব। হাসান কাতার ছেড়ে ঢাকায় ফিরে এলেন, কারণ মেয়ের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী হতে চেয়েছিলেন তিনি। রাবেয়া চাকরি ছেড়ে দিয়ে রোজাবেলের পেছনেই সবটুকু সময় দিতেন। রোজাবেলের জন্য কিনতেন সবচেয়ে দামি খেলনা, সবচেয়ে সুন্দর পোশাক। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার নামকরা মাইলস্টোন কলেজে। রোজাবেলের উজ্জ্বল চোখ আর বুদ্ধিমত্তা দেখে শিক্ষকরা মুগ্ধ হতেন। সে ছিল মেহরিন ম্যামের প্রিয় ছাত্রী, ক্লাসের সবার আগে তার সব বাড়ির কাজ শেষ হয়ে যেত

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, রোজাবেলের প্রিয় বিজ্ঞান ক্লাস। মেহরিন ম্যাম মনোযোগ দিয়ে পরমাণুর গঠন বোঝাচ্ছিলেন। রোজাবেল একদম সামনে বসে সবটুকু শোষণ করছিল। তার মনে নতুন নতুন প্রশ্ন দানা বাঁধছিল। হঠাৎ, একটা বিকট শব্দে পৃথিবীটা থমকে গেল যেন। একটা ভয়ংকর উড়ন্ত দানবের গর্জন, তারপরই এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যে ক্লাসরুমের কাঁচগুলো চুরমার হয়ে গেল, মাথার ওপরের সিলিং ভেঙে পড়তে শুরু করলো। চারিদিকে শুধু আতঙ্কিত শিশুদের চিৎকার। বিমান আছড়ে পড়লো স্কুলের ওপর!

মুহূর্তেই সব কিছু যেন এক নিমিষে পরিবর্তন হয়ে গেল। বাতাসে পোড়া গন্ধ, ধুলো আর ভাঙা কংক্রিটের স্তূপ। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করলো। রোজাবেলের ছোট্ট শরীরটা কিছু বোঝার আগেই যেন আগুনের লেলিহান শিখায় ঝাঁপ দিল। সব স্বপ্ন, সব ভালোবাসা, সব প্রতীক্ষা যেন মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল

হাসান তখন অফিসের মিটিংয়ে। তার ফোন বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে রাবেয়ার হিস্টিরিক্যাল চিৎকার, “হাসান! রোজাবেল! স্কুল… বিমান… আমার রোজাবেল…” প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না হাসান। এ কি করে সম্ভব? তার রোজাবেল? যে রোজাবেলের জন্য তারা ১১ বছর অপেক্ষা করেছে, যে রোজাবেল পৃথিবীর সেরা ডাক্তারদের হাতে জন্ম নিয়েছে, যে রোজাবেলকে তারা এত ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে, সে কি করে এমন হতে পারে?

দ্রুত তিনি স্কুলের দিকে ছুটে গেলেন। চারিদিকে শুধু দমকল বাহিনীর সাইরেন, অ্যাম্বুলেন্সের আর্তনাদ আর মানুষের আর্তনাদ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো এলাকা। স্কুলের প্রতিটি ইটের ফাটলে যেন চাপা কান্না। হাসান পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিলেন, “রোজাবেল! আমার রোজাবেল!” নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু তিনি শুনছিলেন না। ভেঙে পড়া দেয়াল, পোড়া ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে তিনি মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন। রাবেয়া সেখানে দাঁড়িয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন, তার চোখের জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে

ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। উদ্ধার অভিযান চলছিল। পোড়া দেহগুলো একে একে বের করা হচ্ছিল। একেকটি দেহ মানে একেকটি মা-বাবার সারা জীবনের স্বপ্নভঙ্গ। হাসান শুধু খুঁজছিলেন, তার রোজাবেলকে। হয়তো সে কোন কোণে লুকিয়ে আছে, হয়তো একটু ধুলো মাখা হয়ে গেছে, কিন্তু বেঁচে আছে!

অবশেষে, এক উদ্ধারকর্মী নিচু গলায় ডাকলেন, "মি. হাসান?" হাসান ছুটে গেলেন। লোকটির হাতে একটি ছোট কালো ব্যাগ। যেন কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটি প্যাকেট। “দুঃখিত, স্যার।” লোকটি মুখ খুলতেই হাসানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তিনি প্যাকেটের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারলেন। এটা… এটা রোজাবেলের ড্রেসের পোড়া অংশ। ছোট্ট হাত… পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ১১ বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া রোজাবেল, পৃথিবীর সকল হাসপাতাল জয় করে জন্ম নেওয়া রোজাবেল হার মানল ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কাছে

হাসান জ্ঞান হারানোর দোরগোড়ায়। তার পৃথিবীটা যেন কালো এক গহ্বরে তলিয়ে গেল। পোড়া দেহের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা কেবল একটি ছোট্ট মাংসপিণ্ড মাত্র। এই কি তার রোজাবেল? তার সেই ফুটফুটে গোলাপ? যাকে নিয়ে তার এতো স্বপ্ন ছিল?

তিনি হাঁটছিলেন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে। বাতাস ভারি হয়ে আছে পোড়া মাংস আর কেমিক্যালের গন্ধে। তার হাতে সেই ছোট কালো প্যাকেট। তার কোলের ভিতর রোজাবেলের পোড়া দেহ। না, দেহ নয়। দেহের অংশবিশেষ। যে সন্তানের জন্য দিনের পর দিন তিনি ছুটে চলেছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, যে সন্তানের জীবনের জন্য তার স্ত্রী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, সেই সন্তানের জীবন এভাবে নিভে যাবে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি

হাসানের চোখে জল নেই। শুধু পাথরের মতো শূন্য দৃষ্টি। তার সামনে অসংখ্য মানুষ, তাদের চোখেও শোকের ছায়া। কিন্তু হাসান যেন কিছুই দেখছিলেন না। তার কানে শুধু বাজছিল রাবেয়ার সেই অস্ফুট আর্তনাদ – “প্লিজ, বাঁচাও আমার বাচ্চাটিকে…” কিন্তু আজ তার বাচ্চাকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। ১১ বছরের অপেক্ষা, লক্ষ লক্ষ টাকা, হাজারো প্রার্থনা – সব যেন এক ঝটকায় ছাই হয়ে গেল। তার হাত কাঁপছে। কোলের ভিতর রোজাবেলের পোড়া দেহ, আর বুকের ভিতর এক সমুদ্র শূন্যতা। ভাগ্যের এমন লিখন ক’জনই বা পাল্টাতে পারে?

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url