অভিশপ্ত মুক্তি

 অভিশপ্ত মুক্তি

অভিশপ্ত মুক্তি

নির্জন দুপুর। বাইরে কাঠফাটা রোদ। জ্যৈষ্ঠ মাসের এই রোদ যেন শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের দেয়াল থেকে উত্তাপ শুষে নিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। শাবানা রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পেঁয়াজ কাটছিল। এক বছরের ছোট ছেলেটা তার কোলের কাছেই ঘুমিয়ে আছে আর চার বছরের বড় ছেলেটা খেলছে বারান্দায়। স্বামী প্রবাসে, দুই সন্তানের দেখভাল আর সংসারের সব কাজ একা হাতে সামলাতে গিয়ে একাকীত্ব যেন তার নিত্যসঙ্গী। অথচ মাত্র তিরিশ বছর বয়স তার। এই বয়সে অন্য অনেক মেয়েরা যখন স্বামীর হাত ধরে স্বপ্ন দেখে, শাবানা তখন এক নিস্তরঙ্গ জীবনের যাত্রী।

তার মনটা প্রায়শই অস্থির হয়ে উঠত। আট বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল তাদের। স্বামী আসলাম কর্মঠ, দায়িত্ববান। কিন্তু কাজের সূত্রে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে সুদূর মরুর দেশে। প্রথম প্রথম আসলামের বিরহ কষ্ট দিত, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বিরহ পরিণত হয়েছিল একঘেয়েমিতে। শাবানার মনে হতো, তার জীবনটা যেন একটা বন্ধ খাঁচায় আটকা পড়েছে। কোনো রঙ নেই, কোনো সুর নেই।

পাশের বাড়ির মিরাজ ছিল তার একঘেয়ে জীবনের অপ্রত্যাশিত সুর। মিরাজ বিবাহিত, তারও এক সন্তান আছে। কিন্তু লোকটা বখাটে টাইপের। পাড়ায় তার নানা কুকীর্তি নিয়ে কানাঘুষা চলত। চুরি, ডাকাতির মতো ছোটখাটো অপরাধে তার নাম জড়ানোর গুজবও শোনা যেত। এমনকি একবার নাকি একটা হত্যা মামলাতেও তার নাম এসেছিল, যদিও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। মিরাজের পারিবারিক অবস্থাও ছিল বেশ খারাপ। তার বাবা পান-বিড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতেন।

তবে মিরাজের মধ্যে একটা আকর্ষণীয় দিক ছিলসে খুব ভালো কথা বলতে পারত। মিষ্টি কথায় সে যেকোনো মেয়ের মন জয় করে নিতে পারত। শাবানার কাছে সে প্রথম দেখাতেই এসে হেসে বলেছিল, "ভাবী, কেমন আছেন?" সেই শুরু। আসলামের পাঠানো টাকা দিয়ে শাবানা যখন বাজার যেত, মিরাজ প্রায়শই তার পিছু নিত। নানা ছুতোয় কথা বলত, "ভাবী, আপনার ছেলেটা খুব লক্ষ্মী," "ভাবী, আপনার হাতের রান্না নাকি খুব ভালো।" প্রথমে শাবানা পাত্তা দিত না। কিন্তু দিনে দিনে তার একাকীত্ব মিরাজের কথার জাল বুনতে সাহায্য করল।

মিরাজ বুঝতো শাবানার ভেতরের শূন্যতা। সে সেই শূন্যতাকে ভরাটের চেষ্টা করতো। দিনে দিনে তারা কাছাকাছি আসতে শুরু করল। সকালে যখন আসলামের ফোন আসতো, শাবানা চেষ্টা করত তার সাথে স্বাভাবিক কথা বলতে, কিন্তু মনে মনে মিরাজের জন্য একটা গোপন উত্তেজনা কাজ করতো। যখন মিরাজ এসে তার সাথে কথা বলত, শাবানার মনে হতো সে যেন মুক্ত বাতাস গ্রহণ করছে। একসময় তাদের প্রেম শুরু হয়ে যায়। সেই প্রেমের কোনো সামাজিক বা নৈতিক ভিত্তি ছিল না, ছিল শুধু এক অদৃশ্য আকর্ষণের টান।

শাবানা জানতো যে সে ভুল করছে। তার ছোট ছোট দুটি ফুটফুটে সন্তান আছে, আছে একজন স্বামী, যে বিদেশের মাটিতে দিনরাত পরিশ্রম করছে তাদের ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু মিরাজের কাছে এসে সে যেন এক অন্য শাবানাকে খুঁজে পাচ্ছিল। মিরাজ তাকে প্রশংসা করত, তার ছোট ছোট সুখ-দুঃখের কথা মন দিয়ে শুনতো, যা আসলামের কাছে বলা হয়ে উঠত না প্রবাসের শত ব্যস্ততার কারণে।

একদিন মিরাজ শাবানাকে প্রস্তাব দিল, "চলো শাবানা, আমরা পালিয়ে যাই। এই সমাজ, এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাই। আমি তোমাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই।" শাবানার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, এটাই হয়তো তার মুক্তির একমাত্র পথ। সে জানতো এটা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত হবে, কিন্তু তার মন ততক্ষণে মিরাজের মায়াজালে আটকে গেছে। তার মনে হলো, সে এই মুহূর্তে যা পাচ্ছে, তা কোনোদিন আসলামের কাছে পায়নি। আসলামের ভালোবাসার ধরন ছিল দায়িত্বশীলতার, মিরাজের ছিল আবেগ আর উত্তেজনার।

একদিন গভীর রাতে, যখন তার দুই সন্তান ঘুমে অচেতন, শাবানা এক চরম সিদ্ধান্ত নিল। সে তার ব্যাগ গুছিয়ে নিল। এক বছরের ছোট ছেলেটার মুখটা দেখল, তারপর চার বছরের বড় ছেলেটার কপালে শেষবারের মতো একটা আলতো চুম্বন আঁকল। তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, কিন্তু মুক্তির নেশা তাকে অন্ধ করে রেখেছিল। সে শুধু একটা চিরকুটে লিখল, "আমি আর পারছি না। মুক্তি চাই।" তারপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল মিরাজের হাত ধরে। পেছনে পড়ে রইল তার সাজানো সংসার, প্রবাসে থাকা স্বামী আর সবচেয়ে মূল্যবান দুটি শিশু সন্তান।

তারা পালিয়ে গেল অচেনা এক শহরে। সেখানে মিরাজের এক পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে উঠল তারা। দ্রুতই তারা বিয়ে করে নিল। প্রথম কিছুদিন সবটাই রূপকথার মতো মনে হলো। শাবানা ভাবল, সে বুঝি জীবনের সত্যিকারের সুখ খুঁজে পেয়েছে। মিরাজ তাকে খুব ভালোবাসত, চোখে হারা করত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার জন্য চা বানাতো, দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসত। শাবানার মনে হলো, এই স্বাধীনতা, এই ভালোবাসা, এই উত্তেজনা তার জীবনের সব শূন্যতা পূরণ করে দিয়েছে। সে যেন এক নতুন জীবন শুরু করেছে। পুরনো শাবানা, যে ঘরকুনো আর একাকী ছিল, সে যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

কিন্তু বাস্তবের রুক্ষতা বেশিদিন আড়ালে রইল না। মিরাজের ছিল কোনো নিয়মিত আয় নেই। মাঝেমধ্যে সে ছোটখাটো কাজ করত, কিন্তু সেসবে তার মন বসতো না। তার মাথার ভেতর সব সময় বড়লোক হওয়ার সহজ পথ ঘুরপাক খেত। তার পুরোনো অভ্যাসগুলো ফিরে আসতে শুরু করল। রাতে দেরি করে ফেরা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, নেশা করা। শাবানা প্রথম প্রথম কিছু বলতে সাহস করত না। কিন্তু যখন সংসারে অভাব দেখা দিতে শুরু করল, তখন সে মুখ খুলতে বাধ্য হলো।

"মিরাজ, এভাবে আর কতদিন চলবে? কাজ খুঁজে নাও। এভাবে তো সংসার চলে না।" মিরাজ প্রথমে ধমক দিয়ে উঠত, "চুপ করো! তুমি কি আমাকে শিখাবে কী করতে হবে? আমি পুরুষ, আমি জানি কী করতে হবে।" ধীরে ধীরে মিরাজের আসল রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করল। তার মেজাজ খুব খারাপ ছিল। ছোট ছোট বিষয়ে সে রেগে যেত, চিৎকার করত। শাবানা দেখল, মিরাজের চোখ দুটো যেন সব সময় অস্থির। সে প্রায়শই গভীর রাতে কারো সাথে মোবাইলে ফিসফিস করে কথা বলত। একদিন শাবানা বুঝতে পারল, মিরাজ তার পুরোনো অপরাধী বন্ধুদের সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করেছে।

টাকার অভাব যেন এক অদৃশ্য সাপ হয়ে তাদের নতুন সংসারে ঢুকে পড়ল। মিরাজের কথায় আর আচরণে শাবানার প্রতি ভালোবাসা কমতে লাগল। ভালোবাসা ফিকে হয়ে এল, শুরু হলো সন্দেহ আর অবিশ্বাস। শাবানার বাবা-মা ততদিনে তাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। তারা তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ফোন করলে রিসিভ করে না, দেখা করতে গেলেও বাড়ির গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়। "যে মেয়ে নিজের স্বামী আর সন্তানদের ফেলে পালিয়ে যেতে পারে, তার কোনো বাবা-মা নেই," এই কথাগুলো তার কানে যেন বিষ ঢেলে দিত। সমাজের চোখে তারা ছিল এক অবাঞ্ছিত জীব। পুরনো বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল না, নতুন কোনো বন্ধুও জুটল না। শাবানা বুঝতে পারল, সে যেন এক গভীর খাদে নেমে এসেছে, যেখান থেকে উপরে ওঠার কোনো পথ নেই।

একদিন রাতে মিরাজ গভীর নেশায় চুর হয়ে বাড়ি ফিরল। সে শাবানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টাকা নিয়ে মারামারি, গায়ে হাত তোলাএগুলো যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। শাবানা ভয়ে কুঁকড়ে যেত। সে বুঝতে পারল, তার জীবনটা আরও ভয়াবহ অন্ধকারে ডুবে গেছে। যে মুক্তি সে চেয়েছিল, তা আসলে ছিল এক নতুন বন্দিদশা। তার ছোট ছোট সন্তানদের মুখগুলো তার চোখের সামনে ভাসত। তারা কেমন আছে? কে তাদের দেখাশোনা করছে? আসলাম কি তাদের নিয়ে কষ্টে আছে? এই প্রশ্নগুলো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত।

মাস কয়েক পর একদিন পুলিশ মিরাজকে ধরে নিয়ে গেল। পুরনো একটি ডাকাতির মামলায় তার নাম জড়ানো ছিল। মিরাজ জামিন পেল, কিন্তু তারপর থেকে তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করত। সে সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকত। তার মনে হতো পুলিশ তাকে আবার ধরে নিয়ে যাবে। তার এই অস্থিরতা শাবানার জীবনেও বিপদ ডেকে আনল।

এক সময় মিরাজ শাবানার গয়নাগাঁটি বিক্রি করতে শুরু করল, যা সে পালিয়ে আসার সময় এনেছিল। যখন গয়না শেষ হয়ে গেল, তখন সে শাবানাকে চাপ দিতে শুরু করল টাকা জোগাড় করার জন্য। "কথা বলো না কেন? টাকা দরকার। কোত্থেকে টাকা আসবে? যাও, কাজ খুঁজে আনো।" মিরাজের কণ্ঠস্বর ক্রমশ কর্কশ আর রুক্ষ হয়ে উঠছিল। শাবানা চেষ্টা করত কাজ খুঁজতে, কিন্তু তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। যে সামান্য কাজ জুটতো, সে টাকায় একবেলা ভাতও জুটত না।

একদিন তাদের মধ্যে খুব বড় রকমের ঝগড়া হলো। মিরাজ শাবানাকে মারতে উদ্যত হলো। "আমি আর পারছি না মিরাজ," শাবানার গলা কাঁপছিল। "এই জীবন আমার কাছে নরক মনে হচ্ছে।" "নরক মনে হচ্ছে? তাহলে চলে যাও! কে তোমাকে জোর করে আটকে রেখেছে?" মিরাজ চিৎকার করে উঠল। সেই দিনই শাবানা সিদ্ধান্ত নিল। এই সম্পর্ক থেকে তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এই সম্পর্ক তাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে।

পরের দিন সকালে, শাবানা যখন মিরাজ ঘুমাচ্ছিল, তখন তার সামান্য কিছু কাপড় নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এবার তার মনে কোনো মুক্তির আনন্দ ছিল না। ছিল শুধু এক গভীর শূন্যতা আর অনুশোচনা। সে জানত না কোথায় যাবে। তার বাবা-মা তাকে গ্রহণ করবে না, আগের সংসারে ফিরে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। সে যেন এক ভাসমান ডিঙ্গি, যার কোনো গন্তব্য নেই।

শাবানা একটি বস্তির অন্ধকার গলিতে আশ্রয় নিল। ক্ষুধার জ্বালায় সে মানুষের কাছে হাত পাততে শুরু করল। দিনে দিনে তার সুন্দর চেহারাটা মলিন হয়ে গেল, পোশাক ছিঁড়ে গেল। এক সময় যে শাবানা সাজগোজ করে চলাফেরা করত, সে এখন পথের ভিখারিণী। তার চোখে সর্বদা একটা বিষণ্ণতা আর অনুশোচনা খেলা করত। মাঝেমধ্যে দূর থেকে সে তার পুরনো বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত, শুধু তার সন্তানদের এক ঝলক দেখার জন্য। কিন্তু সাহস করে তাদের কাছে যেতে পারত না। যদি আসলাম তাকে দেখে ফেলে? যদি তার সন্তানরা তাকে ঘৃণা করে? এই ভয়ে সে শুধু দূর থেকে তাদের দেখত, আর বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যেত।

অন্যদিকে মিরাজের পরিণতিও ভালো হয়নি। শাবানার চলে যাওয়ার পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে লাগল। পুলিশের খাতায় তার নাম আরও পোক্ত হলো। কয়েকবার জেলখানায় যাওয়া আসা করল। শেষমেশ এক ডাকাতির ঘটনায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার জীবন কাটতে লাগল জেলের চার দেয়ালের ভেতরে। তার জেলের ভেতরের জীবন একাকীত্ব, অনুশোচনা আর অপরাধের গ্লানিতে পূর্ণ। একদিন যে জীবন সে উত্তেজনায় ভরিয়ে রাখতে চেয়েছিল, সেই জীবনই তাকে পলে পলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল।

শাবানা কখনো তার সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে পারেনি। তার অনুশোচনা এতটাই ছিল যে, সে নিজেকে তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার যোগ্য মনে করত না। সে জানত, তার সন্তানরা হয়তো তাকে মা হিসেবে ঘৃণা করে অথবা ভুলে গেছে। বস্তির জীবন তাকে আরও রুগ্ন করে তুলল। অনাহারে, অপুষ্টিতে তার শরীর ভেঙে গেল। তার ভেতরটা সর্বদা হাহাকার করত তার সন্তানদের জন্য। একাকী, নিঃস্ব হয়ে সে পৃথিবীর বুকে টিকে রইল শুধু তার ভুলের মাশুল গোনার জন্য।

একদিন এক শীতের সকালে, শহরের এক নোংরা ফুটপাতে শাবানার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল। কেউ তাকে চিনল না, কেউ জানতে পারল না এই অকালে ঝরে যাওয়া জীবনটার পেছনে কী করুন কাহিনী লুকিয়ে ছিল। তার মৃত্যুর খবর কেউ পেল না, আর পেলেও হয়তো কেউ কাঁদত না। সে নিজেই নিজের হাতে নিজের ভাগ্যকে এমন পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়ে গিয়েছিল। ভালোবাসার মিথ্যা মায়াজাল আর একাকীত্ব থেকে মুক্তির ভুল পথ তাকে এনে দাঁড় করিয়েছিল এক ভয়াবহ পরিণতিতে, যেখানে তার জন্য রইল শুধুই অনুতাপ আর একাকী মৃত্যু।

 

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url