ভালোবাসার পাপ
***ভালোবাসার পাপ***
সোহানা সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছে। তার চোখে
স্বপ্নের ঝিলিক, মনে অদম্য উৎসাহ। গ্রামের স্কুল থেকে ভালো ফলাফল করে সে যেন
এক নতুন দিগন্তের স্বপ্ন দেখছিল। তার বড় বোন শাবানা, সাত বছর পূর্বে পাশের
গ্রামের স্বপনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। তাদের দাম্পত্য জীবন গ্রামবাসীদের
কাছে উদাহরণস্বরূপ ছিল। এক ছেলে সজল আর এক মেয়ে বৃষ্টির কলকাকলিতে তাদের সংসার ছিল
পরিপূর্ণ। স্বপন ছিল শান্ত স্বভাবের, পরিশ্রমী একজন মানুষ। তার ছোটখাটো ব্যবসা ছিল,
যা দিয়ে তারা
সুখেই দিনাতিপাত করছিল।
সোহানা যখন বড় হয়ে উঠছিল, তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল
আপার বাড়িতে। শাবানা আর স্বপনের সংসারে সে যেন এক মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ত। স্বপন
দুলাভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। সোহানা দুলাভাইয়ের সাথে গল্প করে,
বাজারের ফর্দ
করে দিয়ে, ছোটখাটো কাজ করে দিয়ে সময় কাটাতো। দুলাভাইও সোহানাকে ছোট
বোনের মতোই দেখত, আদর করত। এই সম্পর্ক কখন যে এক ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গেল,
তা কেউ টেরই
পেল না।
মাসখানেক হলো সোহানার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটি শহরের,
দেখতে শুনতে
ভালো, অবস্থাপন্ন
পরিবারের। পরিবারের পছন্দেই এই বিয়ে হয়েছিল। সোহানার মনে হয়তো কিছুটা অপ্রাপ্তি
ছিল, কিন্তু সে মুখ
ফুটে কিছু বলেনি। নতুন জীবনে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সে। শ্বশুরবাড়িতে সাতদিন
সে ছিল এক নতুন পরিবেশে। নতুন মানুষ, নতুন রীতি-নীতি। সবকিছুই তার কাছে কেমন অচেনা আর
বাঁধাধরা মনে হচ্ছিল। এরই মাঝে সে স্বপনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল। মোবাইল
ফোনের এই যুগে দূরত্বের বাঁধন আলগা। পুরনো সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কখন যেন আরও
গভীর, আর আরও নিষিদ্ধ
হয়ে উঠেছে।
সাত দিনের মাথায় সোহানা দুলাভাই স্বপনের সাথে
পালিয়ে যায়।
এই খবরটি যখন দুই পরিবারে পৌঁছালো, তখন যেন আকাশ
ভেঙে পড়লো। প্রথমে disbelief, তারপর shock, এরপর গভীর রাগ আর তীব্র ঘৃণা। শাবানার পৃথিবী
যেন মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তার স্বামী, তার জীবনসঙ্গী, তাকে ছেড়ে চলে
গেছে, তাও আবার তার
নিজেরই ছোট বোনকে নিয়ে! এ কেমন বিশ্বাসঘাতকতা! বুক চাপড়ে সে কাঁদতে শুরু করলো,
“এ কী করলে
স্বপন? এ কেমন অবিচার!
আমার বোন! আমার নিজের ছোট বোন!”
শাবানার বাবা-মার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এক
মেয়ের সাত বছরের সংসার ভেঙে গেল, আর অন্য মেয়ে সমাজের চোখে অপরাধী হয়ে গেল। শত শত প্রশ্ন,
হাজারো কটু কথা
তাদের বিঁধতে শুরু করলো। “ছি ছি, এ কেমন কাজ! নিজের ভগ্নিপতিকে নিয়ে পালিয়ে যায়! এ মুখ এখন
গ্রামে দেখাবো কী করে!”
সোহানার শ্বশুরবাড়িতেও নেমে আসলো ভয়াবহ দুর্যোগ।
বিয়ের মাত্র সাত দিনের মাথায় বউ পালিয়ে গেল, তাও আবার নিজ বোনের স্বামীর
সাথে! যে সম্মান আর স্বপ্ন নিয়ে সোহানাকে ঘরে এনেছিল, তা মুহূর্তের মধ্যে চুরমার
হয়ে গেল। সোহানার স্বামী রাশেদ প্রথমে হতবাক, তারপর চরমভাবে অপমানিত বোধ
করলো। তার পরিবার এই অপমানে ফুঁসছিল। তারা অবিলম্বে সোহানাকে তালাক দেওয়ার
সিদ্ধান্ত নিল। মেয়েরা সমাজের এই কলঙ্ক আর দুর্নাম মেনে নিতে পারলো না।
গ্রামের হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে, এমনকি বাড়ির
উঠোনে পর্যন্ত এই ঘটনাই হয়ে উঠল আলোচনার মূল বিষয়। ফিসফাস, কানাঘুষা, জল্পনা-কল্পনা
যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। কেউ সোহানার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল, কেউ স্বপনের
লোলুপতাকে দায়ী করল। শাবানাকে নিয়ে সহানুভূতি থাকলেও, তার ভাগ্যের জন্য অনেকেই
‘নিয়তি’ কে দায়ী করলো। তার পরিবারকে শুনতে হলো অসংখ্য তিরস্কার আর অপবাদ।
শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে শাবানা সন্তানদের
নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলো। তার বাবা-মা, যারা মেয়ের এমন সর্বনাশ দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন,
তাদেরও এখন
সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার দশা। শাবানার মা অনবরত কাঁদতেন, আর বাবা গভীর
চিন্তায় ডুবে থাকতেন। গ্রামের মানুষজন তাদের এড়িয়ে চলত, তাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে
বাঁকা হাসি হাসত।
সজল আর বৃষ্টি – এই নিষ্পাপ দুটি শিশু – তাদের
জীবনেও যেন নেমে আসলো অন্ধকার। বাবা নেই, মা সারাক্ষণ কাঁদে। তারা ছোট, কিন্তু
চারপাশের চাপা উত্তেজনা আর কানাঘুষা তাদের হৃদয়ে আঘাত হানছিল। স্কুলে বন্ধুরা
হাসাহাসি করত, শিক্ষকরাও কেমন যেন এড়িয়ে চলতেন। সজল প্রায়ই জিজ্ঞেস করত,
‘‘বাবা কেন আসে
না, মা? কেন আমাদের
দেখতে আসে না?’’ শাবানার কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না। সে শুধু তাদের বুকে
জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদত।
এদিকে, সোহানা আর স্বপনের জীবনও সুখে কাটছিল না। গ্রাম
ছেড়ে তারা শহরের এক অপরিচিত গলিতে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথম প্রথম হয়তো এক ধরনের
মুক্তির আনন্দ ছিল। কিন্তু সেই আনন্দ কর্পূরের মতো উবে যেতে বেশি সময় লাগেনি।
পরিবার, পরিচিত সমাজ,
বন্ধু-বান্ধব –
সব ছেড়ে এসে তারা যেন এক অথৈ সমুদ্রে ভাসছিল।
স্বপন, যে গ্রামের সফল ব্যবসায়ী ছিল, শহরের এই ভিড়ের
মাঝে নিজেকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করলো। তার ছোটখাটো ব্যবসা এখানে চলল না। অশিক্ষিত
আর অপরিচিত হওয়ায় ভালো কোনো কাজও পেল না। যা ছিল, তা দ্রুতই ফুরিয়ে গেল।
সোহানা, যে কিনা
স্বপ্নে বিভোর ছিল, সেও বাস্তবতার কঠিন রূপ দেখতে পেল। তারা যে ভালোবাসার জন্য
এত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিল, সেই ভালোবাসা দ্রুত ম্লান হতে শুরু করলো নিত্যদিনের অভাব আর
অনিশ্চয়তার কাছে।
স্বপনের ভেতরে থাকা অস্থিরতা আর হতাশা প্রকট হতে
শুরু করলো। সে প্রায়শই সোহানার সাথে ঝগড়া করত, তাদের এই দুঃসাহসিক
সিদ্ধান্তের জন্য সোহানাকেই দায়ী করত। সোহানা ভাবতো, এ তো সেই দুলাভাই নয়,
যাকে ঘিরে তার
রঙিন স্বপ্ন ছিল। এই লোকটা ক্লান্ত, বিরক্ত আর রুক্ষ। তার মনে অনুশোচনা দানা বাঁধতে
শুরু করলো। গ্রামের সেই সরল জীবন, বাবা-মায়ের স্নেহ, অপার ভালোবাসা –
সব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
তারা দুজনেই নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেল। সোহানার দিক থেকে তার বাবা-মা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। স্বপনের
বাবা-মাও পুত্র আর পুত্রবধূর এই ধিকৃত কাজ মেনে নিতে পারেননি। তারা তাদের নাম মুখে
আনতেও ঘৃণা বোধ করতেন। স্বপনের সম্পত্তি বলতে যা ছিল, তা তার বাবা ছোট ছেলে আর
শাবানার সন্তানদের নামে লিখে দিয়েছিলেন।
কয়েক বছর কেটে গেল।
শাবানা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিল। সে জানত,
সন্তানদের
মুখের দিকে চেয়ে তাকে বাঁচতে হবে। গ্রামের মহিলাদের সহায়তায় সে হাঁস-মুরগি পালন
শুরু করলো। তারপর ধীরে ধীরে সবজি চাষেও হাত লাগালো। তার বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ হয়েছেন।
শাবানা তাদের ভরসা হয়ে দাঁড়াল। সমাজের কটু কথা আর তীর্যক দৃষ্টির সাথে মানিয়ে নিতে
সে শিখেছিল। তার চোখে তখন আর হতাশা ছিল না, ছিল দৃঢ়তা আর এক নতুন
জীবনের প্রতিজ্ঞা। সজল আর বৃষ্টি বড় হচ্ছে। মায়ের কষ্ট তারা বুঝতে শেখে। সজল
স্কুলের পর মাকে সাহায্য করে। বৃষ্টি মায়ের আঁচল ধরে ঘুর ঘুর করে। শাবানা তাদের
ভবিষ্যৎ গড়তে মরিয়া।
অন্যদিকে, সোহানা আর স্বপন এক
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলছে। তাদের জীবন থেকে রোমাঞ্চ আর উচ্ছ্বাস কবেই
বিদায় নিয়েছে। তারা শহরের এক বস্তির মতো জায়গায় ছোট একটি ঘরে ভাড়া থাকত। স্বপন এখন
রিকশা চালায়, মাঝে মাঝে দিনমজুরি করে। সোহানা একটি পোশাক কারখানায় কাজ
করে। তাদের জীবন শুধু টিকে থাকার এক নিরন্তর সংগ্রাম। তাদের মুখে হাসি নেই,
চোখে নেই কোনো
স্বপ্ন। তারা নীরবে একে অন্যের সঙ্গ দিত, কারণ তাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। তাদের
সম্পর্কটা ভালোবাসার চেয়ে অভ্যাসের, কিংবা পাপের ভাগীদার হিসেবে বেঁচে থাকার এক
অদ্ভুত বোঝাপড়ার মতো হয়ে গেছে।
একদিন স্বপন রিকশা চালাতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায়
পড়ল। গুরুতর আহত হয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি হলো। সোহানা তার সমস্ত সঞ্চয় ভেঙে,
ধার-দেনা করে
তার চিকিৎসা করাল। সেই কঠিন সময়েও সোহানা একবারও নিজের বাবা-মা কিংবা আপার কথা
ভাবেনি। সে জানত, তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তাদের পাপের বোঝা
এতটাই ভারী যে, তারা আর কোনোদিন সমাজের অংশ হতে পারবে না।
যখন স্বপন সুস্থ হয়ে উঠলো, সে আর আগের মতো
কাজ করতে পারল না। তার হাঁটতে কষ্ট হতো, রিকশা চালানোর শক্তি তার ছিল না। সোহানা একাই
সংসারের হাল ধরেছিল। ফ্যাক্টরির কাজ করে যা পেতো, তা দিয়ে কোনোরকম টেনেটুনে
চলত। তাদের মাঝে কোনো অভিযোগ ছিল না, কোনো ভালবাসা ছিল না, ছিল শুধু নীরব আত্মসমর্পণ।
শাবানা একদিন বাজারে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল এক নারীর দিকে। ফ্যাকাসে মুখ,
কোঁকড়ানো চুল,
ক্লান্ত শরীর –
এ কি সোহানা? তার নিজের ছোট বোন? শাবানার হৃদপিণ্ড মুহূর্তের জন্য যেন থেমে গেল।
এই সেই সোহানা, যে তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল? এই সেই রূপবতী
সোহানা, যার দিকে
তাকিয়ে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই মুগ্ধ হতো?
সোহানার চোখও শাবানার উপর পড়ল। মুহূর্তেই সে
মাথা নামিয়ে নিল, যেন লজ্জায় সে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছে। পুরনো সেই
দুষ্টুমি ভরা চোখের তারায় আজ শুধু বিষাদ আর অনুশোচনা। সে দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে
হাঁটতে শুরু করলো। শাবানা আর একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। তার মনে কোনো ঘৃণা
ছিল না, ছিল শুধু এক
অদ্ভুত করুণা। সে বুঝল, তাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফল তারা ভোগ করছে। তাদের 'ভালোবাসার'
পরিণতি কতটা
ভয়াবহ হতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ছিল সোহানার বর্তমান জীবন।
শাবানা ফিরে এসে বাচ্চাদের দিকে তাকাল। সজল এখন
ক্লাস এইটে পড়ে, বৃষ্টি ক্লাস ফাইভে। তারা ভালো ছাত্র-ছাত্রী। শাবানা তাদের
পড়ানোর জন্য দিনে দশ বারো ঘণ্টা কাজ করে। সে বুঝল, তার সংগ্রাম হয়তো আরও বেশি
কঠিন ছিল, কিন্তু তার জীবনে সম্মান আর সততা ছিল। তার সন্তানরা তার
গর্ব।
সোহানা আর স্বপন বেঁচে আছে, কিন্তু তাদের
জীবন যেন তাদেরই তৈরি করা এক কারাগারে বন্দি। এই গল্প যেন সমাজের প্রতিটি মানুষকে
মনে করিয়ে দেয় যে, নিষিদ্ধ সম্পর্ক আর অবৈধ ভালোবাসার পরিণতি কতটা মর্মান্তিক
হতে পারে। এক মুহূর্তের ভুল, এক পৈশাচিক সিদ্ধান্ত দুটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে,
স্বপ্নগুলোকে
ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে, আর অজস্র মানুষের জীবনকে নরকে পরিণত করতে পারে। সোহানার
এসএসসি পাশ করার পর দেখা স্বপ্নগুলো আজ এক দুঃস্বপ্নের মতো, আর শাবানার জীবনে নেমে আসা
দুর্যোগ যেন এক নীরব, মর্মস্পর্শী আর্তনাদ। তাদের জীবনে নেমে আসা এই দুর্যোগের
শেষ কোথায়, তা কেবল সময় জানে।