গুপ্তধনের রহস্য ও দুই বন্ধুর অভিযান
শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, এক নিস্তব্ধ
গ্রামে বাস করতো শুভ আর অয়ন নামে দুই বন্ধু। তাদের জীবন আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতোই।
সকালে ওঠে, চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়, ছোটখাটো কাজ
করে দিন কাটায়। কিন্তু এই সরল জীবনের গভীরে লুকিয়ে ছিল অদম্য কৌতূহল আর
অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। শুভ একটু শান্ত, বই পড়তে ভালোবাসে, ইতিহাস আর
ভূগোল তার পছন্দের বিষয়। অয়ন তার উল্টো, একটু বেশি চঞ্চল, হুটহাট
সিদ্ধান্ত নিতে ওস্তাদ, কিন্তু তার সাহসের কোনো তুলনা হয় না। তাদের বন্ধুত্বটা ছিল
অদ্ভুত, যেন দুই ভিন্ন মেরুর মানুষ, কিন্তু একে অপরের পরিপূরক।
এক বর্ষার দুপুরে, গ্রাম্য মেলায়
একটা পুরনো বইয়ের দোকান থেকে খুব কম দামে একটা জীর্ণ বাঁধাই করা বই কেনে শুভ। বইটা
ছিল এলাকার জমিদার বংশের এক পূর্বপুরুষের লেখা দিনলিপি। কেনার সময় বিশেষ আগ্রহ ছিল
না, স্রেফ প্রাচীনত্বের প্রতি ভালোবাসা থেকে কেনা। কিন্তু বাড়িতে এসে পাতা ওল্টাতে
গিয়ে তার চোখ আটকে যায়। বইয়ের শেষ পাতায়, দিনলিপির লেখার নিচে, একটা ভাঁজ করা
কাগজ লুকানো ছিল। সাবধানে কাগজটা বের করে শুভ। সেটা একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটা হাতে নিতেই শুভ বুঝতে পারে এটা
সাধারণ কিছু নয়। পাতলা, হলদেটে কাগজটা স্পর্শ করলেই বোঝা যায় এর বয়স অনেক। অদ্ভুত
কিছু চিহ্ন আঁকা, চেনা স্থানের নাম নেই বললেই চলে, শুধু কিছু
ইঙ্গিত, কিছু আঁকাবাঁকা রেখা আর একটা বড়সড় 'X' চিহ্ন, যা কোনো এক নির্দিষ্ট স্থানকে নির্দেশ করছে।
নিচে লেখা আছে কিছু অস্পষ্ট শব্দ, কোনো প্রাচীন ভাষায় বা সাংকেতিক লিপিতে, যা শুভ প্রথম
দেখায় বুঝতে পারে না। তার মনটা কেমন যেন করে ওঠে। অজানা এক উত্তেজনা শিরায় শিরায়
ছড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যায় অয়ন এলে তাকে মানচিত্রটা দেখায় শুভ।
অয়ন প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেয়। "আরে ধুর! এসব বইয়ের পাতায় আঁকা বাচ্চাদের খেলা!
গুপ্তধন টু গুপ্তধন কিচ্ছু নেই।"
কিন্তু শুভ দমবার পাত্র নয়। "দেখ অয়ন,
কাগজটা অনেক পুরনো। আর এই চিহ্নগুলো দেখ। এগুলো সাধারণ কিছু নয়। মনে হচ্ছে
কোনো নির্দিষ্ট জায়গার কথা বলছে।"
অয়ন মানচিত্রটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে। তার
চোখও ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি তার সহজাত আকর্ষণ মাথাচাড়া
দিয়ে ওঠে। "কিন্তু এটা কিসের মানচিত্র? আর এই
চিহ্নগুলোই বা কীসের?"
শুভ বলে, "সেটাই तो রহস্য। এই যে
লেখাগুলো আছে নিচে, এগুলো decipher করতে পারলেই হয়তো কিছু বোঝা যাবে।"
পরের কয়েকটা দিন চরম ব্যস্ততায় কাটে তাদের। শুভ পুরনো
ভাষা আর সাংকেতিক লিপি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা শুরু করে। গ্রামের পাঠাগার, ইন্টারনেট,
যা কিছু হাতের কাছে পায় সব ঘাঁটতে থাকে। অয়ন তার পরিচিত লোকজনের সাথে কথা বলে
এলাকার পুরনো ইতিহাস, কিংবদন্তী জানার চেষ্টা করে।
ধীরে ধীরে রহস্যের জাল খুলতে শুরু করে। শুভ
জানতে পারে, মানচিত্রের নিচের লেখাগুলো প্রাচীন বাংলার একটি লুপ্তপ্রায়
ভাষার অংশ। টানা তিন রাত পড়াশোনার পর সে কয়েকটি শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে পারে। 'গুপ্ত',
'প্রাচীন', 'রক্ষা', 'অন্ধকার'। এই শব্দগুলো যেন রহস্যকে আরও গভীর করে তোলে।
এদিকে অয়ন জানতে পারে, প্রায় দুশো বছর
আগে এই অঞ্চলে একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন, যার নাম ছিল
রঘুপতি দেবরায়। তিনি অত্যন্ত ধনী ছিলেন এবং ব্রিটিশদের সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল
না। শোনা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং প্রচুর
ধনসম্পদ তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কিংবদন্তী আছে,
তিনি সেগুলোকে একটি দুর্গম স্থানে লুকিয়ে একটি জটিল ধাঁধার জাল বুনেছিলেন,
যাতে কেবল সঠিক ব্যক্তিই খুঁজে বের করতে পারে। শুভ যে দিনলিপিটি কিনেছিল,
সেটি ছিল সেই জমিদার রঘুপতি দেবরায়েরই দাদার লেখা। সম্ভবত মানচিত্রটি রঘুপতির
তৈরিই ছিল।
শুভ আর অয়নের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। এটা
একটা গুপ্তধনের মানচিত্র। কেবল সোনাদানা নয়, হয়তো এর সাথে
জড়িয়ে আছে দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাদের সাধারণ জীবন হঠাৎ করেই
অসাধারণ হয়ে ওঠে।
অভিযানে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কিন্তু
কাজটা সহজ ছিল না। মানচিত্রের প্রথম চিহ্নটি ছিল গ্রামের পশ্চিমে এক প্রাচীন
বটগাছ। সেখানে গিয়ে দেখে বটগাছের গোড়ায় একটি পাথর বসানো। পাথরটি সরাতে নিচে একটি
ছোট কুঠুরি পাওয়া যায়, তার ভেতরে একটি ধাতব বাক্স। বাক্সটি খুলতেই তারা দ্বিতীয়
ক্লু পায় - একটি তামার পাত, তাতে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা।
তামার পাতের চিহ্নগুলো ছিল আরও জটিল। শুভ তার
নতুন জ্ঞান ব্যবহার করে সেগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। অনেক পরিশ্রমে সে বুঝতে
পারে, এটি আসলে একটি নির্দেশিকা। এটি বলছে তাদের যেতে হবে গ্রামের উত্তর-পূর্বে,
পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি পুরনো মন্দিরে।
পাহাড়ের পথ দুর্গম। বর্ষার শেষে পথ আরও পিচ্ছিল
হয়ে আছে। বন্যপ্রাণীর ভয়, অজানা পরিবেশের ঝুঁকি - সবকিছু জেনেও তারা থামে না। অয়নের
সাহস আর শুভর বুদ্ধির জোরে তারা এগিয়ে চলে। দুদিন ধরে দুর্গম পথ হেঁটে তারা অবশেষে
সেই মন্দিরে পৌঁছায়। মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত, চারদিকে আগাছা
আর ভেঙে পড়া মূর্তি।
মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে তারা। মানচিত্রে আঁকা
কিছু রেখার সাথে মন্দিরের ভেতরের স্থাপত্যের মিল খোঁজার চেষ্টা করে। খুঁজে পায়
একটি গোপন কুঠুরি, যা একটি ভারী পাথরের আড়ালে ঢাকা। পাথর সরাতে তারা দুজনে
মিলে অনেক কসরত করে। অবশেষে যখন পাথরটি সরে যায়, ভেতরে দেখা যায়
একটি ছোট সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গটি এতটাই অন্ধকার যে ভেতরে কিছু দেখা যায় না।
অয়ন কিছুটা ভয় পেলেও শুভর মুখে দৃঢ়তা দেখে সেও
সাহস ফিরে পায়। তাদের হাতে ছিল ছোট টর্চলাইট। টর্চের আলোয় তারা সুড়ঙ্গের ভেতরে
প্রবেশ করে। সুড়ঙ্গটি এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। ভেতরে কেমন যেন একটা
স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। বাদুড়ের ওড়াউড়ি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
কিছুদূর যাওয়ার পর সুড়ঙ্গটি একটি বড় গুহায় এসে
শেষ হয়। গুহার ভেতরে ঢুকেই তারা চমকে যায়। গুহার একপাশে বেশ কিছু পাথরের সিন্দুক
রাখা। আলো ফেলে দেখে সিন্দুকগুলোর গায়ে অদ্ভুত কারুকার্য করা। তাদের হৃদস্পন্দন
বেড়ে যায়। এত পরিশ্রমের ফল কি তবে তারা পেতে চলেছে?
কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান এত সহজ ছিল না।
সিন্দুকগুলো খোলা ছিল না। সেগুলোর ডালায় ছিল আরেকটি জটিল ধাঁধা। এবার সেটি ছিল
ছন্দের আকারে লেখা। শুভ সেই প্রাচীন ভাষার জ্ঞান দিয়ে ছন্দের অর্থ বোঝার চেষ্টা
করে। ছন্দটির প্রতিটি লাইনে একটি করে ইঙ্গিত ছিল।
প্রথম ইঙ্গিত ছিল - "যেথা সূর্য প্রথম চুমু
খায়, পশ্চিমের দ্বার সেথা লুপ্ত প্রায়।" এর মানে কী হতে পারে? তারা গুহার
পশ্চিম প্রান্তে আলো ফেলে। সেখানে সত্যিই একটি ছোট ফাটল দেখতে পায়, যা প্রথম দেখায়
চোখে পড়ে না। ফাটলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তারা একটা ছোট পাথর খুঁজে পায়, যা সিন্দুকের
ডালায় লাগানো একটি ছিদ্রের সাথে মাপমতো খাপ খায়।
দ্বিতীয় ইঙ্গিত - "অন্ধকার কাঁদে যেথায়,
জলের ধারা সেথায় বয়।" গুহার ভেতরে একটি অংশে স্যাঁতস্যাঁতে ছিল, আর সেখানে ছোট
ছোট ফোঁটা জল উপর থেকে পড়ছিল। সেই জায়টা খুঁজে তারা আরেকটি পাথর পায়।
এভাবে একে একে ছন্দের ইঙ্গিত অনুসরণ করে তারা
মোট সাতটি পাথর খুঁজে বের করে। ধাঁধাটি ছিল আসলে একটি লকিং মেকানিজম। সাতটি পাথরকে
সিন্দুকের ডালায় নির্দিষ্ট সাতটি ছিদ্রের মধ্যে সঠিক ক্রমে স্থাপন করতে হবে।
কোন পাথর কোন ছিদ্রে যাবে, আর তার ক্রম কী
হবে, তা নিয়ে তারা অনেকক্ষণ গবেষণা করে। শুভ ছন্দের গভীরে লুকিয়ে থাকা প্রতীকী অর্থ
বোঝার চেষ্টা করে। অয়ন তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে পাথরের আকার আর ছিদ্রের গঠন মেলায়।
অনেক ভুল করার পর, প্রায় হতাশ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, শুভ হঠাৎ বুঝতে
পারে ছন্দের শেষ লাইনটির আসল মানে। সেটি ছিল - "সাত তারা মিলে পথ দেখায়,
পূর্বের আলোয় সে দ্বার খোলায়।" এটা সপ্তর্ষিমণ্ডলের কথা বলছে! আর পূর্বের
আলো মানে ভোরের আলো।
তাদের মনে পড়ে যায়, মানচিত্রে একটি
ছোট তারকারাজি আঁকা ছিল, যা তারা প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি। সেটা হয়তো সপ্তর্ষিমণ্ডলের
বিন্যাস ছিল। তারা ছন্দের লাইনগুলিকে সপ্তর্ষিমণ্ডলের তারার সাথে মেলায় এবং
পাথরগুলোকে সেই ক্রমানুসারে সিন্দুকের ডালায় বসায়।
ঠিক যেমন তারা ভেবেছিল, শেষ পাথরটি
বসানোর সাথে সাথে একটি ক্লিক শব্দ হয়। সিন্দুকের ডালা খুলে যায়!
ভিতরে সোনা, রূপা, হীরা-পান্না
ঝলমল করছে! তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এত সম্পদ তারা একসাথে আগে কখনো দেখেনি। তাদের
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে!
কিন্তু সিন্দুকের একপাশে, ধাতব মুদ্রা আর
গয়নার নিচে, একটি চামড়ার থলে দেখতে পায় তারা। থলেটি বের করে খুলতেই দেখা
যায় তার ভেতরে রয়েছে কিছু প্রাচীন কাগজপত্র আর একটি ছোট কাঠের বাক্স।
কাগজপত্রগুলো ছিল জমিদার রঘুপতি দেবরায়ের নিজের
হাতে লেখা। তাতে তিনি জানিয়েছেন কেন এবং কোথায় তিনি এই ধনসম্পদ লুকিয়েছিলেন। তিনি
সত্যিই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং এই সম্পদ
লুকিয়েছিলেন আন্দোলনের কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু তার আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন
এবং আর ফিরে আসতে পারেননি। মানচিত্রটি ছিল তার বিশ্বস্ত সহচরের জন্য তৈরি, কিন্তু তিনিও
হয়তো রহস্যের কারণে খুঁজে বের করতে পারেননি।
কাগজপত্রের মধ্যে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নথি
ছিল। একটি ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আন্দোলনের সময়কার কিছু গোপন
পরিকল্পনা আর নেতাদের তালিকা। আরেকটি ছিল ব্রিটিশদের অত্যাচার এবং নির্যাতনের উপর
ভিত্তি করে লেখা একটি বিস্তারিত রিপোর্ট, যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য ছিল।
এই নথিগুলো ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ, যা এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।
কাঠের বাক্সটি খোলে তারা। ভেতরে ছিল একটি ছোট
মূর্তিও একটি প্রাচীন কলম। মূর্তিটি ছিল মা কালীর, যা জমিদার
মশাইয়ের আরাধ্য দেবী ছিলেন। কলমটি ছিল সম্ভবত তার প্রিয় লেখার সরঞ্জাম। এসব
ব্যক্তিগত জিনিস গুপ্তধনের সাথে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, হয়তো
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
শুভ আর অয়ন বুঝতে পারে, এই গুপ্তধন
কেবল আর্থিক মূল্যের নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক বীরের আত্মত্যাগ, দেশের জন্য
ভালোবাসা আর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানচিত্রের রহস্য শুধু ধনসম্পদের পথ
দেখায়নি, দেখিয়েছে অতীতের এক লুকানো সত্যকেও।
তারা সিদ্ধান্ত নেয় এই সম্পদ তারা ব্যক্তিগত
স্বার্থে ব্যবহার করবে না। অন্তত ঐতিহাসিক নথিগুলো তারা সরকারের প্রত্নতত্ত্ব
বিভাগের হাতে তুলে দেবে, যাতে এগুলোর সঠিক সংরক্ষণ এবং গবেষণা হয়। ধনসম্পদ কী করবে
তা নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে, তবে আপাতত তাদের কাছে ইতিহাসের এই লুকানো সত্যটাই বেশি
মূল্যবান মনে হয়।
গুহা থেকে বের হওয়ার পর তারা খেয়াল করে বাইরে
ভোরের আলো ফুটছে। দীর্ঘ রাত আর কঠিন পরিশ্রমের পর সূর্যের আলোয় তাদের চোখ জুড়িয়ে
যায়। কিন্তু তাদের এই অভিযান শেষ হওয়ার আগেই অন্য এক রহস্য তাদের সামনে উদয় হয়।
গুহার মুখ থেকে কিছুটা দূরে, তারা অন্য
পায়ের ছাপ দেখতে পায়। একাধিক মানুষের পায়ের ছাপ! তার মানে কি অন্য কেউও এই গুপ্তধন
খুঁজছিল? নাকি তারা আসার আগেই অন্য কেউ এসে ঘুরে গেছে?
তাদের আনন্দ কিছুটা কমে যায়। তারা বুঝতে পারে
গুপ্তধনের এই খবর যদি অন্য কেউ জানতে পারে, তাহলে বিপদ
অনিবার্য। বিশেষ করে যদি সেটা কোনো অসাধু ব্যক্তি হয়।
তারা দ্রুত গুহার মুখটা পাথর দিয়ে আবার ঢেকে দেয়,
যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। তারপর মানচিত্র আর পাওয়া জিনিসপত্র
সাবধানে নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করে। নামার পথে তারা আরও সতর্ক হয়ে যায়।
প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নড়াচড়ার দিকে তাদের কান খোলা থাকে।
গ্রামের কাছাকাছি এসে তারা আরও একটি অদ্ভুত
জিনিস লক্ষ্য করে। গত দুদিনে তারা গ্রামের পথে যাদের দেখেছে, তাদের মধ্যে
কয়েকজন অচেনা লোক ঘোরাঘুরি করছে, তাদের হাবভাব সন্দেহজনক। তারা কি গুপ্তধনের খোঁজেই এসেছে?
শুভ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করার
চেষ্টা করে। জমিদার রঘুপতি দেবরায়ের বংশধররা কি এখনো আছে? তারাই কি
খুঁজছে তাদের পূর্বপুরুষের সম্পদ? নাকি অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এই গোপন খবর জেনে গেছে?
তারা সোজা নিজেদের বাড়িতে ফেরে না। গ্রামের
বাইরে তাদের পরিচিত এক বিশ্বস্ত লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে বসে তারা নতুন করে
পরিস্থিতি বিবেচনা করে। অয়ন উত্তেজিত হয়ে বলে, "চল ওদের
মুখোমুখি হই! কারা ওরা দেখি।"
কিন্তু শুভ তাকে থামায়। "না অয়ন, হুট করে কিছু
করা ঠিক হবে না। আমরা জানি না ওদের উদ্দেশ্য কী, ওরা কারা,
আর ওদের কাছে কী আছে। যদি ওরা গুপ্তধনের কথা জেনে থাকে, তাহলে আমরা এখন
সবচেয়ে বেশি বিপদে আছি।"
তারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে তারা
ঐতিহাসিক নথিগুলো সুরক্ষিত করবে। তারপর গ্রামের মোড়ল এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত বয়স্ক
লোকের সাথে কথা বলে জমিদার বংশের ইতিহাস এবং বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে জানার
চেষ্টা করবে।
পরের দিন খুব সাবধানে তারা গ্রামের পরিবেশ
পর্যবেক্ষণ করে। অচেনা লোকগুলো সত্যিই তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছিল, সেটা প্রায়
নিশ্চিত হয় তারা। শুভ দ্রুত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন পরিচিত অধ্যাপকের সাথে ফোনে
যোগাযোগ করে এবং প্রাপ্ত নথিগুলোর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। অধ্যাপক অত্যন্ত উৎসাহিত
হন এবং যত দ্রুত সম্ভব নথিগুলো তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
নথিগুলো শহরে নিয়ে যাওয়াটাই এখন সবথেকে বড়
চ্যালেঞ্জ। অচেনা লোকগুলো নিশ্চয়ই তাদের উপর নজর রেখেছে। শুভ আর অয়ন মিলে একটা
পরিকল্পনা করে। তারা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। শুভ একটি নকল থলেতে কিছু সাধারণ
পুরনো কাগজ ঢুকিয়ে অন্য পথে শহরে যাবে, আর অয়ন আসল নথি ও মানচিত্র নিয়ে অন্য পথে যাবে,
তাও রাতের অন্ধকারে। এই পরিকল্পনাটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু তাদের
মনে হয়েছিল এটাই একমাত্র উপায়।
রাতের অন্ধকারে অয়ন যখন গ্রামের বাইরে দিয়ে শহর
পানে রওনা দিচ্ছিল, তখন সে টের পায় কেউ তাকে অনুসরণ করছে। অন্ধকারে সে বুঝতে
পারে না কে বা কারা তারা। অয়ন গতি বাড়ায়। কিন্তু অনুসরণকারীরাও তার পিছু ছাড়ে না।
একটা সময় সে বুঝতে পারে সে ফেঁসে গেছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে শুভ, যে অন্য পথে
যাচ্ছিল, তার মনে হয় অয়ন বিপদে পড়তে পারে। তার সহজাত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
তাকে সাবধান করে দেয়। সে দ্রুত তার যাত্রাপথ পরিবর্তন করে অয়নের দিকে যায়।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে শুভ দেখে অয়ন কয়েকজন
লোকের সাথে ধস্তাধস্তি করছে। লোকগুলোর হাতে ধারালো অস্ত্র চকচক করছে। শুভ দেরি না
করে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে লোকগুলো কিছুটা
হকচকিয়ে যায়। এই সুযোগে অয়ন এক ধাক্কা দিয়ে একজনকে সরিয়ে দেয় এবং দ্রুত দৌড় লাগায়।
শুভও তার পিছু নেয়।
লোকগুলো তাদের ধাওয়া করে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে
দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটা গভীর খাদের কাছে এসে পড়ে। আর পালানোর জায়গা নেই। লোকগুলো
তাদের প্রায় ধরে ফেলে।
"তোমাদের কাছে
যা আছে দিয়ে দাও! নয়তো ফল ভালো হবে না!" একজন লোক হুমকি দিয়ে ওঠে।
তাদের মধ্যে একজন ছিল বয়স্ক এবং বাকিরা তার
চেলা। বয়স্ক লোকটির চেহারা কিছুটা পরিচিত মনে হয় শুভর। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে
করতে পারে না।
অয়ন আর শুভ বুঝতে পারে পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
তারা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকগুলোর উপর। অয়ন তার সাহস আর শারীরিক শক্তি দিয়ে
মোকাবিলা করার চেষ্টা করে, আর শুভ বুদ্ধি খাটিয়ে লোকগুলোকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।
কিন্তু সংখ্যায় এবং অস্ত্রে তারা এগিয়ে ছিল।
ঠিক যখন তারা প্রায় পরাস্ত হতে চলেছে, তখন গ্রামের
কিছু সাহসী যুবক, যারা অয়ন আর শুভর উপর নজরদারী বুঝতে পেরেছিল এবং তাদের পিছু
নিয়েছিল, তারা এসে হাজির হয়। লাঠি হাতে তারা অচেনা
লোকগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় এক তুমুল মারপিট।
গ্রামের যুবকদের সাহসে অচেনা লোকগুলো পিছু হটতে
বাধ্য হয়। দুজন ধরাও পড়ে যায়। বাকিরা অন্ধকারে পালিয়ে যায়।
ধরা পড়া লোক দুজনকে জেরা করে জানা যায়, তারা আসলে
জমিদার রঘুপতি দেবরায়ের দূর সম্পর্কের কিছু বংশধর। তারা লোকমুখে কিংবদন্তী শুনেছিল
এবং দীর্ঘদিন ধরে গুপ্তধনের সন্ধান করছিল। গ্রামে অচেনা লোক দেখে তারা বুঝতে পারে
অন্য কেউও খুঁজছে। গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়ার পর তারা শুভ আর অয়নকে অনুসরণ করছিল।
বয়স্ক লোকটি ছিল তাদের সর্দার, গ্রামের মেলায় যে বই বিক্রি হয়েছিল, তার খোঁজ সেই
রেখেছিল।
রহস্যের জট খোলে। গুপ্তধনের পেছনে কারা ছিল,
সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু তারা বুঝতে পারে, পালিয়ে যাওয়া
লোকগুলো হয়তো আবার ফিরে আসবে।
শুভ আর অয়ন দ্রুত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের
অধ্যাপককে খবর দেয়। পরদিন সকালেই পুলিশ ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি দল গ্রামে এসে
পৌঁছায়। গুহাটি সিল করে দেওয়া হয় এবং ঐতিহাসিক নথিগুলো সুরক্ষিতভাবে শহরে নিয়ে
যাওয়া হয়। ধনসম্পদের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানায়।
শুভ আর অয়নের জীবন আবার আগের মতো শান্ত হয়ে যায়
না। তারা রাতারাতি গ্রামের হিরো হয়ে ওঠে। সবাই তাদের সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার
প্রশংসা করে। গুপ্তধনের সন্ধান হয়তো তাদের ধনী করেনি (কমপক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে),
কিন্তু তাদের নাম ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে দেয়।
তাদের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়। তারা বুঝতে পারে,
আসল গুপ্তধন কেবল সোনাদানা নয়, সাহসিকতা, বন্ধুত্ব, জ্ঞান আর ইতিহাসের প্রতি সম্মানই আসল সম্পদ। তাদের অভিযান
শেষ হয়, কিন্তু সেই অ্যাডভেঞ্চারের রেশ তাদের মনে থেকে যায়। তারা বুঝেছিল, পৃথিবীতে এমন
অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যা কেবল কৌতূহলী মন আর সাহসী হৃদয় দিয়ে খুঁজে বের করা যায়।
এবং সেই সন্ধান যাত্রাই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। হয়তো ভবিষ্যতে আরও এমন কোনো
রহস্য তাদের হাতছানি দেবে, আর তারা আবার বেরিয়ে পড়বে অজানা পথে, নতুন এক
অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে।
সকল গল্প পড়তে ক্লিক করুন- বাংলা গল্প এবং English Stories