এক ভৌতিক রাত

 এক ভৌতিক রাত

দোলেশ্বরের এক ভৌতিক রাত

সালটা ২০২৫। গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষার আগমনী। বিকেল থেকেই আকাশ কালো করে ছিল, কিন্তু বৃষ্টি নামেনি। বাতাস থমথমে। দোলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হক সাহেবের মুখটা চিন্তায় কুঁচকে আছে। আজ উপবৃত্তির তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করার শেষ দিন। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে প্রায়, অথচ এখনও অনেক ছাত্রছাত্রীর ডেটা এন্ট্রি বাকি। বাড়িতে ওয়াইফাই নেই, থাকলে এতক্ষণে কাজটা সেরে ফেলতে পারতেন। একমাত্র ভরসা স্কুলের কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ

কিন্তু সমস্যা হলো, এত রাতে একা স্কুলে যেতে কেমন অস্বস্তি লাগে। গ্রাম এলাকা, রাত বাড়লেই চারপাশ নিশুতি হয়ে যায়। বিদ্যুতের আলোও সব জায়গায় পৌঁছায় না। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে তিনি ডাকলেন রবিউলকে। রবিউল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, বেশ চটপটে। রবিউল আসতেই হক সাহেব তাকে বুঝিয়ে বললেন পরিস্থিতি। আরও কয়েকজন ছাত্রকে খবর দিতে বললেন, যারা একটু সাহসী আর রাতে বাড়ি থেকে বেরোতে অনুমতি পাবে

রবিউল ছুটলো। কিছুক্ষণ পর তার সাথে এলো তোসিন, ইব্রাহিম আর তাইফ। চারজনই বেশ বড়সড় আর সাহসীদের দলে। অভিভাবকদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে অবশ্য একটু বেগ পেতে হয়েছে, কিন্তু হক সাহেবের জরুরি কাজের কথা শুনে তাঁরা রাজি হয়েছেন

মাগরিবের নামাজ শেষ করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তাঁরা। হক সাহেব আগে, পেছনে চারজন ছাত্র। মেঠো পথ, দু'ধারে ঝোপঝাড়, আবছা অন্ধকারে কেমন ছমছমে পরিবেশ। স্কুলের কাছাকাছি আসতেই সবাই কেমন চুপ মেরে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দোলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়টাকে এই আবছা আলো-আঁধারিতে অন্যরকম লাগছিল। দিনেরবেলার হৈ হুল্লোড়ের জায়গাটা এখন শুনশান, নিস্তব্ধ

স্কুলের গেটে এসে হক সাহেব তালা খুললেন। মরচে ধরা গেট ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে গেটটা ভেজিয়ে দিলেন। স্কুলের লম্বা বারান্দায় পা রাখতেই ঠান্ডা একটা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো। ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে বলে আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, তাই কম্পিউটার রুমে আলো জ্বালাতে সমস্যা হলো না

কম্পিউটার রুমটা স্কুলের এক কোণায়। ভেতরে ঢুকতেই কেমন স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নাকে এলো। হক সাহেব কম্পিউটার অন করলেন। ছেলেরা গুটিসুটি মেরে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তোসিন বলল, "স্যার, অন্য ঘরগুলো দেখি একেবারে অন্ধকার হয়ে আছে!"

হক সাহেব বললেন, "থাক বাবা, ওসব দিকে গিয়ে কাজ নেই। আমরা শুধু এই ঘরে কাজ করবো আর দ্রুত বাড়ি ফিরে যাব।"

রবিউল বলল, "স্যার, আমার একটু ভয় ভয় লাগছে।"

হক সাহেব হেসে বললেন, "ধুর বোকা ছেলে! স্কুল দিনেরবেলা আমাদের খেলার জায়গা, রাতেরবেলা আবার ভয়ের কী আছে? আমি আছি তো!"

সত্যি বলতে, হক সাহেবের নিজেরও একটু ভয় লাগছিল। স্কুলের একটা পুরনো গল্প আছে, অনেক বছর আগে নাকি এই স্কুলেই এক ছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। সে নাকি এখনও এই স্কুলেই ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের অনেকেই রাতেরবেলা স্কুলের আশেপাশে নানা শব্দ শোনার দাবি করে। হক সাহেব অবশ্য এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আজকের পরিবেশটা কেমন যেন গা ছমছমে

তিনি কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রি শুরু করলেন। ছাত্ররা চুপচাপ বসে দেখছিল। প্রথমে তোসিন, ইব্রাহিম আর তাইফ মোবাইলে গেম খেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু নেটওয়ার্ক একেবারে না থাকায় কিছুক্ষণ পর হাল ছেড়ে দিল। তারা একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিল

সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। ডেটা এন্ট্রির কাজটা যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছিল। একটা এন্ট্রি শেষ করে সেভ দিতেই কারেন্ট চলে গেল

"আরে ধুর!" বিরক্ত হলেন হক সাহেব। "এই সময় কারেন্ট গেল!"

চারদিক হঠাৎ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। শুধু স্কুলের বাইরে গ্রামের দু-একটা বাড়ির টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। বাইরে বাতাস ছেড়েছে মনে হয়, পুরনো টিনের চালার উপর দিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে

"স্যার, কী হবে এখন?" রবিউল জিজ্ঞেস করল ভয়ে ভয়ে

"দাঁড়াও দেখি, জেনারেটরটা অন করা যায় কিনা। হেডমাস্টার সাহেব তো চাবিটা আমাকেই দিয়ে গেছেন।" হক সাহেব জেনারেটরের চাবি খুঁজতে লাগলেন

হঠাৎ, একদম অপ্রত্যাশিতভাবে, স্কুলের ভেতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো

শব্দটা ঠিক কীসের, প্রথমে বোঝা গেল না। কেমন গম্ভীর, অনেকটা ঢেঁকিশালের গম গুম শব্দ, কিন্তু আরও ভারী, আরও অস্বাভাবিক। মনে হলো স্কুলের পেছনের দিক থেকে আসছে

হক সাহেব আর ছাত্ররা সবাই নড়েচড়ে বসলো

"এটা কিসের শব্দ স্যার?" তোসিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল

"জানি না তো!" হক সাহেব নিজেও অবাক। এই শব্দটা পরিচিত নয়। কোনো পশু নয়, প্রকৃতির শব্দও নয়

শব্দটা একবার হয়েই থেমে গেল। চারপাশে আবার সেই নিস্তব্ধতা। শুধু বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক

সকলেই উৎকর্ণ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রগুলোর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তাদের ভয়

হঠাৎ, সেই শব্দের কিছুক্ষণ পরেই, আরও একটা শব্দ ভেসে এলো। এবার আর গম্ভীর শব্দ নয়, এবার স্পষ্ট কান্নার শব্দ

একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ

খুব করুণ, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। শব্দটা যেন স্কুলের ভেতরের কোনো একটা ঘর থেকে আসছে

ছেলেগুলো একে অপরের গায়ে সেঁটে গেল। তোসিন ভয়ে কাঁপছিল। ইব্রাহিম "ও আল্লাহ" বলে উঠল। তাইফ হক সাহেবের শার্ট খামচে ধরল

হক সাহেব নিজেও ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠেছেন। কান্নার শব্দটা কি? কার কান্না?

"স্যার... স... স্যার... এটা...এটা কিসের কান্না?" রবিউল তোতলিয়ে জিজ্ঞেস করল

হক সাহেব যতটা সম্ভব শান্ত গলায় বললেন, "হয়তো বাইরে থেকে কোনো শব্দ আসছে। বাতাসের জন্য এমন মনে হচ্ছে।"

কিন্তু তিনি নিজেও জানেন এটা বাইরের শব্দ নয়। এটা স্কুলের ভেতর থেকেই আসছে

কান্নার শব্দটা ধীরে ধীরে যেন স্পষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ স্কুলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে। কান্নার সাথে কেমন যেন গোঙানির শব্দও শোনা যাচ্ছিল

হক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জেনারেটরের চাবি খোঁজা বন্ধ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আলো জ্বালানো বা ডেটা এন্ট্রি করা কোনোটাই মাথায় নেই। শুধু এই অদ্ভুত শব্দ আর কান্নার উৎস জানার তীব্র কৌতুহল আর তার সাথে মিশে থাকা ভয়

"তোমরা এখানেই থাকো। আমি একটু দেখে আসি।" হক সাহেব বললেন

"না স্যার! যাবেন না! একা যাবেন না!" ছাত্রগুলো ভয়ে চিৎকার করে উঠল

"ভয় পেয়ো না। আমি বেশিদূর যাব না।"

কিন্তু একা যেতে তার নিজেরও সাহস হচ্ছিল না। ছাত্রগুলো তার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। তাদের এখানে একা রেখে যাওয়াটাও নিরাপদ মনে হলো না

"আচ্ছা, তোমরা আমার পেছনে পেছনে এসো। সাবধানে, কোনো শব্দ করবে না।" হক সাহেব পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন। মোবাইলের টর্চটা জ্বালালেন। টিমটিমে আলোয় চারপাশের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় মনে হচ্ছিল

কম্পিউটার রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় পা রাখলেন সবাই। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে, কিন্তু স্কুলের ভেতরে বাতাসটা কেমন জমাট বাঁধা, ভারী। কান্নার শব্দটা এখন আরও স্পষ্ট। মনে হচ্ছে বারান্দার শেষ মাথায়, যেখানে পুরনো লাইব্রেরি রুমটা আছে, সেদিক থেকে আসছে

হক সাহেব ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন। মোবাইলের আলোটা সামনে ফেলে ফেলে এগোচ্ছেন। পেছনে ছাত্ররা গুটিসুটি মেরে তার জামা ধরে আছে। তাদের শরীর ভয়ে কাঁপছে

পুরনো বারান্দাটা পার হতে যেন অনন্তকাল লাগছে। প্রতিটা পদক্ষেপে মেঝে থেকে একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে, যা এই নিস্তব্ধতায় ভীতিকর শোনাচ্ছে। বারান্দার দেয়ালে অনেক পুরনো নোটিশ আর ছবি ধুলো পড়ে আরও ভৌতিক লাগছে

কান্নার শব্দটা এবার ঠিক লাইব্রেরি রুমের সামনে থেকে আসছে। দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ভেতরে অন্ধকার

হক সাহেবের বুকটা ধুকপুক করছে। ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাদের মুখ দিয়ে কথা সরছে না। চোখগুলো বড় বড় হয়ে আছে

তিনি আলতো করে লাইব্রেরি রুমের দরজায় টোকা দিলেন

কোনো উত্তর এলো না। কান্নাটাও হঠাৎ থেমে গেল

চারপাশে আবার সেই আদিম নিস্তব্ধতা। শুধু তাদের ভারী নিশ্বাস আর দ্রুত হৃদস্পন্দনের শব্দ

হক সাহেব ধীরেসুস্থে দরজাটা ঠেললেন। ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরের অন্ধকারটা যেন আরও ঘন। মোবাইলের আলোটা ভিতরে ফেললেন। পুরনো বইয়ের গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে ভাব। চেয়ার-টেবিলগুলো এলোমেলো পড়ে আছে। কিন্তু ভেতলে কেউ নেই

তাহলে কান্নার শব্দটা কোথা থেকে এলো?

ছাত্ররা ভয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। তাইফ ফিসফিস করে বলল, "স্যার... এটা নিশ্চয়ই সেই গল্পের ভূত!"

হক সাহেবের গা ছমছম করে উঠল। সেই গল্প! গ্রামের পুরনো গল্পটা। দোলেশ্বরের সেই মেয়েটার গল্প, যে এই স্কুলেই মারা গিয়েছিল। জুই। নামটা মনে পড়তেই একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল

"চলো, এখান থেকে চলে যাই," হক সাহেব বললেন। তার গলা সামান্য কাঁপছিল

তারা লাইব্রেরি রুম থেকে বের হয়ে আবার বারান্দা দিয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালো। কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই, বারান্দার অন্য প্রান্তে, হেডমাস্টারের রুমের দিক থেকে একটা ছায়া নড়ে নড়ে উঠল

মোবাইলের টিমটিমে আলোয় ছায়াটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। কিন্তু মনে হলো যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে

হক সাহেব আর ছাত্ররা জমে গেল

"ওটা কী স্যার?" তোসিন ভয়ে গলা শুকিয়ে জিজ্ঞেস করল

হক সাহেব কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি স্থির চোখে ছায়াটার দিকে তাকিয়ে রইলেন

ছায়াটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো। মনে হলো একজন ছোট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও তার পরনে সাদা রঙের কিছু একটা বোঝা যাচ্ছে

আর তার ঠিক নিচেই... মেঝেতে... জমাট বাঁধা রক্তের মতো কিছু একটা পড়ে আছে

ছাত্রদের মধ্যে একজন অস্ফুটে চিৎকার করে উঠল

হঠাৎ করেই মেয়েটা মাথা তুলল। তার চোখ দেখা গেল না, কিন্তু মনে হলো সে সরাসরি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে

আর তারপর, সেই করুণ, ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা আবার শুরু হলো। ঠিক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির কাছ থেকে!

জুইয়ের গল্পটা মনে পড়ে গেল হক সাহেবের। স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল সে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে লাইব্রেরি রুমের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেকের মতে, তার আত্মা নাকি মুক্তি পায়নি

মেয়েটি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তার শরীরটা কেমন যেন স্বচ্ছ, আবছা। পা মেঝেতে স্পর্শ করছে না, যেন ভেসে আসছে। কান্নার শব্দটা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে একটা চাপা আর্তনাদ

ছাত্ররা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হক সাহেবের পেছনে আশ্রয় নিল। হক সাহেবের নিজের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তিনি এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না

মেয়েটি যত কাছে আসছিল, স্কুলের ভেতরের পরিবেশটা তত ঠান্ডা আর ভারী হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল বাতাস কেউ শুষে নিচ্ছে

হঠাৎ, তাইফ চিৎকার করে দৌড় দিল। সে বারান্দা দিয়ে গেটের দিকে ছুটছে

"তাইফ! দাঁড়া!" বলে চিৎকার করে উঠলেন হক সাহেব

কিন্তু তাইফ তখন প্রাণের ভয়ে ছুটছে

আর ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। বারান্দার ঠিক মাঝখানে এসে মনে হলো অদৃশ্য কোনো দেওয়াল তাকে ধাক্কা মারল। তাইফ ছিটকে বারান্দার রেলিংয়ে ধাক্কা খেল। তার হাতের মোবাইলটা ছিটকে পড়ে গেল

মেয়েটা এবার বারান্দা ধরে তাইফের দিকে এগোতে লাগল। কান্নার শব্দটা যেন হাসিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছিল, একটা বিকৃত, বীভৎস হাসি

হক সাহেব আর অন্য ছাত্ররা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভয় যেন তাদের পাথর করে দিয়েছে

"তোরা দৌড়া! গেটের দিকে দৌড়া!" হক সাহেব চিৎকার করে উঠলেন। এই মুহূর্তে ছাত্রদের বাঁচানোই তার একমাত্র লক্ষ্য

তিনি যত দ্রুত সম্ভব রবিউল, তোসিন আর ইব্রাহিমকে ঠেলে গেটের দিকে পাঠালেন। তিনি নিজেও দৌড় দিলেন তাদের সাথে। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটা খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে, তার সাদা পোশাক অন্ধকারে উড়ছে, আর সেই বীভৎস হাসিটা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে

বারান্দা পার হয়ে স্কুলমাঠের দিকে আসতেই মনে হলো চারপাশের গাছপালাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঘন অন্ধকার আর ঝোপঝাড়গুলো যেন আটকে রাখতে চাইছে তাদের

তারা তিনজন গেটের দিকে ছুটছিল। গেটটা ভেজানো ছিল, খুলতে সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু গেটের কাছাকাছি এসে দেখল, গেটটা ভেতর থেকে আটকানো!

কে আটকাল?

তাদের পেছনের বারান্দা থেকে ধেয়ে আসছে সেই আত্মা। তার কান্নার সাথে মিশে গেছে হিসহিস শব্দ

হক সাহেব মরিয়া হয়ে গেট ঠেলতে লাগলেন। মরচে ধরা গেটটা যেন আজ তাদের আটকে রাখার জন্যই বদ্ধপরিকর

তোসিন আর ইব্রাহিম ভয়ে কাঁপছে, রবিউল হক সাহেবকে গেট খুলতে সাহায্য করার চেষ্টা করছে

আত্মাটা খুব কাছে চলে এসেছে। ঠান্ডা বাতাস আর সেই বীভৎস হাসি এখন তাদের কানের কাছে

হঠাৎ, রবিউলের মনে পড়ল, প্রধান ফটক না খুললে পেছনের ছোট গেটটা দিয়েও বেরুনো যায়। ওটা সাধারণত লাগানো থাকে না

"স্যার! পেছনের গেট!" রবিউল চিৎকার করে উঠল

আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না হক সাহেব। গেট খোলার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তিনি ছাত্রদের নিয়ে স্কুলের পেছন দিকের ছোট গেটটার দিকে দৌড় দিলেন

পেছনের দিকটা আরও অন্ধকার, আরও ঝোপঝাড়পূর্ণ। কিন্তু প্রাণের টানে তারা ছুটছিল। পেছনে সেই আত্মা ধাওয়া করছে, তার ঠান্ডা ছোঁয়া যেন পিঠের কাছে অনুভব করা যাচ্ছে

ছোট গেটের কাছে এসে হক সাহেব গেটটা ঠেলতেই খুলে গেল। লাগানো ছিল না

তিনজন একসঙ্গে গেটের বাইরে ঝাঁপ দিল। গেটের বাইরে গ্রামের পথ। আলো না থাকলেও, স্কুল ভবনের ভেতরের অন্ধকারের চেয়ে এখানকার অন্ধকার কম ভীতিকর মনে হলো

গেটের বাইরে নেমেই তারা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। অন্ধকারের মধ্যেই গ্রামের পথ ধরে ছুটতে লাগল বাড়ির দিকে। পেছনে স্কুল ভবনের দিক থেকে ভেসে আসছিল সেই করুণ কান্না আর তীব্র আর্তনাদ। আর তার সাথে মিশে ছিল একটা চাপা ক্ষোভ আর যন্ত্রণা

অনেকটা পথ দৌড়ে আসার পর তারা থামল। হাফাতে হাফাতে একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। জামাকাপড় ধুলোয় নোংরা

"তা... তাইফ...?" তোসিন তোতলিয়ে বলল

হক সাহেবের মনে পড়ল। তাইফ! সে বারান্দায় ছিটকে পড়েছিল। সে কি বের হতে পেরেছে?

তাদের কারোর কাছেই মোবাইল নেই। হক সাহেবের ফোন স্কুলের কম্পিউটার রুমে পড়ে আছে হয়তো। তাইফের ফোনটাও পড়ে গেছে বারান্দায়

তারা দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকার রাস্তায়। স্কুলের দিক থেকে আর কোনো শব্দ আসছে না। শুধু দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে

তাদের চারজনের মধ্যে এখন তিনজন। রবিউল, তোসিন আর ইব্রাহিম। তাইফ নেই

হক সাহেব ছাত্রদের দিকে তাকালেন। তাদের চোখেমুখে চরম ভয় আর অসহায়ত্ব। তিনি নিজে কি করবেন বুঝতে পারলেন না। ফিরে যাবেন স্কুলে? একা? সেই ভয়ের মুখে?

না, এই রাতে আর কিছুতেই স্কুলের বারান্দায় পা রাখা সম্ভব নয়

"চল... চল বাড়িতে যাই..." হক সাহেব ভাঙ্গা গলায় বললেন। "কাল সকালে... কাল সকালে দেখা যাবে।"

কিন্তু তিনি জানতেন, কাল সকালে স্কুল ভবনে গিয়ে তারা কী দেখবে, বা আদৌ তাইফকে খুঁজে পাবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দোলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই রাত তাদের জীবনে এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর জুইয়ের আত্মা... সে কি চিরকাল ওই স্কুলেই আটকে থাকবে? নাকি আজ রাতে তার শিকারের সন্ধান পেয়েছে...? প্রশ্নের উত্তর অজানা, কিন্তু ভয়টা ছিল সত্যি। সেই রাত ছিল দোলেশ্বরের এক ভৌতিক রাত। আর উপবৃত্তির ডেটা এন্ট্রি? সেটা আর কোনোদিন করা হয়নি হয়তো...


আরও গল্প পড়তে ভিজিট করুন: The World of Story

 

 

 

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم

Ad

Ad