শালিখা বনের রহস্য
হক সাহেব কপালে ঘাম মুছলেন। যদিও পৌষের শেষ বিকেল।
কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সূর্যটা যেন তাড়াতাড়িই গাছের আড়ালে লুকানোর জন্য ব্যস্ত
হয়ে পড়েছে। চারপাশের আবছা আলোয় পথ হারিয়ে যাওয়া দলটিকে আরও অসহায় দেখাচ্ছে।
হক সাহেব, স্থানীয় একটি সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রতি বছর শীতকালে তিনি তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের
নিয়ে বনভোজনে যান। এবারেও গিয়েছিলেন, দশজন ছাত্রছাত্রী – নাইম, অদ্রি, খুশি, মিম, শাপলা, মোহনা, সোহাম, নয়ন, সোহানা, জেরিন- এদেরকে
নিয়ে শালিখা বনের গভীরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, শহরের ইট-কাঠের জীবনে বন্দি
থাকা বাচ্চাদের একটু প্রকৃতির স্বাদ দেওয়া, বনের সৌন্দর্য দেখানো।
কিন্তু প্রকৃতির রূপ দেখাতে গিয়েই আজ বিপদে
পড়েছেন হক সাহেব। উৎসাহের বশে শিশুদের নিয়ে তিনি বনের ভেতরে অনেকটা পথ হেঁটে ফেলেছিলেন। এখন
ফেরার পথে বুঝতে পারছেন, তারা পথ হারিয়ে ফেলেছেন।
"স্যার, আমার খুব ভয়
করছে," মিমের গলা ধরে আসছিল।
"স্যার, বাড়ি যাব কখন?"
নয়ন ডুকরে
কেঁদে উঠলো।
বাকি বাচ্চাদের চোখেমুখেও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
হক সাহেব তাদের ভয় পাওয়াটা বুঝতে পারছিলেন। তিনি নিজেও যথেষ্ট চিন্তিত। সন্ধ্যা
প্রায় হয়ে এসেছে। এই গভীর জঙ্গলে রাতে থাকার মত কোনো আশ্রয়ও তাদের জানা নেই।
"ভয়ের কিছু নেই। আমরা ঠিক
রাস্তা খুঁজে বের করবো," হক সাহেব তাদের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার নিজের
মনেও সংশয় জাগছিল।
হক সাহেব শিশুদের নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। বনের ভেতরে সরু পথগুলো একে অপরের সাথে
মিশে গেছে, কোন পথে গেলে তারা লোকালয়ে ফিরতে পারবে, তা বোঝা মুশকিল।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হক সাহেবের নজরে পড়ল,
দূরে গাছের
ফাঁক দিয়ে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল তার। জনবসতি না
হয়েও তো কিছু একটা হতে পারে। তবুও আশা ছাড়তে চাইলেন না তিনি।
"ঐ দেখো, আলো!"
তিনি শিশুদের দেখালেন। "মনে হচ্ছে ওখানে কোনো বাড়ি আছে।"
আলো দেখে শিশুদের মুখেও কিছুটা স্বস্তি ফিরল। তারা আবার উৎসাহের সঙ্গে
হাঁটতে শুরু করলো।
কাছে যেতেই হক সাহেব দেখলেন, সত্যিই একটা
বাড়ি। পুরনো দিনের একতলা একটা বাড়ি। চারদিকে গাছপালা আর জঙ্গলে ঘেরা। বাড়িটা দেখে
বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে।
হক সাহেব শিশুদের নিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। "কেউ আছেন?"
তিনি ডাকলেন।
কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তারপর ভেতর
থেকে ক্ষীণ একটা কণ্ঠ ভেসে এল, "কে?"
হক সাহেব বললেন, "আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।
আপনাদের এখানে একটু আশ্রয় পেতে পারি?"
কিছু সময় পর দরজা খুলল। একজন বৃদ্ধ মানুষ
দাঁড়িয়ে আছেন। রোগা শরীর, কোঁচকানো মুখ, সাদা দাড়ি। তার চোখগুলোতে কেমন যেন একটা উদাসীন
দৃষ্টি।
"ভেতরে আসুন," বৃদ্ধ লোকটি
বললেন।
হক সাহেব শিশুদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরের পরিবেশটা বাইরের থেকেও
অদ্ভুত। পুরনো দিনের আসবাবপত্র, দেওয়ালে ঝুলানো পুরনো ছবি। ঘরগুলোতে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা
গন্ধ।
বৃদ্ধ লোকটি তাদের বসতে দিলেন। "আপনারা
কারা? আর এই গভীর
জঙ্গলে কী করছেন?" তিনি জানতে চাইলেন।
হক সাহেব তাদের আসার কারণ খুলে বললেন। শুনে
বৃদ্ধ লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, "আপনারা আজ রাতে এখানেই
থাকুন। কাল সকালে আমি আপনাদের পথ দেখিয়ে দেব।"
হক সাহেব রাজি হলেন। এই মুহূর্তে আর কোনো উপায়ও
ছিল না।
বৃদ্ধ লোকটি তাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করলেন।
সামান্য চাল-ডাল আর কিছু সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করলেন। শিশুরা ক্ষুধার্ত ছিল,
তাই তারা
তৃপ্তি করে খেল।
খাওয়ার পর বৃদ্ধ লোকটি তাদের শোবার জন্য একটা ঘর
দিলেন। ঘরটা বেশ বড়। এতে বাচ্চাদের জন্য বিছানা পাতা হলো।
রাতে হক সাহেবের ঘুম আসছিল না। তিনি ভাবছিলেন,
এই বৃদ্ধ লোকটি কে? কেন তিনি এই গভীর জঙ্গলে একা থাকেন? তার অতীতটা কেমন? নানা প্রশ্ন
তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
চারদিকে অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর বন্য জীবজন্তুর আওয়াজ রাতের নীরবতাকে আরও
গাঢ় করে তুলেছে।
হঠাৎ হক সাহেবের নজরে পড়ল, বৃদ্ধ লোকটি
বাড়ির পেছনের দিকে কোথায় যেন যাচ্ছেন। তার হাতে একটা হারিকেন। হক সাহেবের মনে
সন্দেহ হলো। তিনি বৃদ্ধ লোকটির পিছু নিলেন।
বৃদ্ধ লোকটি জঙ্গলের ভেতরে একটা পুরনো কবরের
কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি হারিকেনটা কবরের পাশে রাখলেন। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে
শুরু করলেন।
হক সাহেব এগিয়ে গেলেন। "আপনি কাঁদছেন কেন?"
তিনি জিজ্ঞেস
করলেন।
বৃদ্ধ লোকটি হক সাহেবের দিকে তাকালেন। তার চোখ
দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। "আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই জঙ্গলে আমার স্ত্রী মারা
গিয়েছিল। আমি তাকে এখানেই কবর দিয়েছি।"
বৃদ্ধ লোকটি বলতে শুরু করলেন, "আমরা দুজনে এই
জঙ্গলে ঘুরতে এসেছিলাম। হঠাৎ একটা বন্য প্রাণী আক্রমণ করে। আমি তাকে বাঁচাতে
পারিনি। এরপর থেকে আমি এখানেই আছি। তার কবরের পাশে।"
হক সাহেব বৃদ্ধ লোকটির কষ্টের কথা বুঝতে পারলেন।
তিনি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
পরের দিন সকালে বৃদ্ধ লোকটি হক সাহেবদের পথ
দেখিয়ে দিলেন। বনের বাইরে এসে হক সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি বৃদ্ধ লোকটির কাছে
কৃতজ্ঞতা জানালেন।
"আমি কি আপনার জন্য কিছু
করতে পারি?" হক সাহেব জানতে চাইলেন।
বৃদ্ধ লোকটি মাথা নেড়ে বললেন, "আমার কিছু
লাগবে না। আপনার শিশুদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিলেই আমি খুশি।"
হক সাহেব শিশুদের নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হলেন। তাদের মনে তখন নানা প্রশ্ন।
তারা বৃদ্ধ লোকটির কথা ভাবছিল। তার কষ্টের কথা ভাবছিল।
গ্রামের কাছাকাছি এসে হক সাহেব দেখলেন, একটা জিপ
দাঁড়িয়ে আছে। জিপটা তাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের। তিনি হক সাহেবদের খোঁজে
এসেছিলেন।
প্রধান শিক্ষক তাদের দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি
হক সাহেবকে বললেন, "আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। তোমরা কোথায় ছিলে?"
হক সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বললেন। শুনে প্রধান
শিক্ষক অবাক হলেন। তিনি বললেন, "আমি এই জঙ্গলের অনেক ভেতরে গিয়েছি, কিন্তু কোনোদিন
কোনো বাড়ি দেখিনি। আর কোনো বৃদ্ধ লোকের কথাও শুনিনি।"
হক সাহেব প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না।
কিন্তু প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে তার মনে সন্দেহ জাগলো। তাহলে তিনি কাল রাতে কার
সাথে কথা বলেছিলেন? কে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল?
হক সাহেব শিশুদের নিয়ে আবার সেই বাড়ির খোঁজে গেলেন। কিন্তু গিয়ে দেখলেন,
সেখানে কোনো
বাড়ি নেই। শুধু একটা পুরনো কবরস্থান।
হক সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাহলে কি তিনি
কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন? নাকি অন্য কিছু ঘটেছিল?
শিশুরা কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। তারা বলল,
"স্যার, কাল রাতে আমরা
এই কবরস্থানের পাশের বাড়িতেই তো ছিলাম!"
হক সাহেব বুঝতে পারলেন, কাল রাতে তারা কোনো সাধারণ
বাড়িতে আশ্রয় নেয়নি। তারা হয়তো কোনো ভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
ঘটনাটি হক সাহেব এবং তার ছাত্রছাত্রীদের জীবনে
এক গভীর ছাপ ফেলে গেল। তারা সবাই বুঝতে পারলো, প্রকৃতি যেমন সুন্দর,
তেমনই রহস্যময়।
আর গভীর জঙ্গলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে, যা আমাদের ধারণার বাইরে।
বছর ঘুরে যায়।
একদিন, হক সাহেব ক্লাসে শিশুদের পড়াচ্ছেন। পুরনো দিনের কথা
বলতে গিয়ে তিনি শালিখা বনের সেই রাতের ঘটনার উল্লেখ করলেন।
তখন নাইম নামের একটি ছেলে হাত তুলে বলল,
"স্যার, আমার মনে আছে,
সেই রাতে বৃদ্ধ
লোকটি আমাদের একটা গল্প শুনিয়েছিলেন।"
"কী গল্প?" হক সাহেব জানতে
চাইলেন।
নাইম বলল, "গল্পটা ছিল এক রাজার। যে
তার রাজ্যের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।"
অদ্রি বলল, "আমার মনে আছে, বৃদ্ধ লোকটি
বলেছিলেন, ভালোবাসা আর ত্যাগের মধ্যেই জীবনের আসল সুখ।"
খুশি বলল, "আর আমার মনে আছে, তিনি বলেছিলেন,
ভয়কে জয় করতে
পারলেই সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায়।"
হক সাহেব শিশুদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সেই রাতের ঘটনা
তাদের জীবনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ভয়, ভালোবাসা, ত্যাগ – জীবনের
এই কঠিন সত্যগুলো তারা সেই রাতেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
হক সাহেব মুচকি হাসলেন। তিনি জানেন, শালিখা বনের
সেই রাতের রহস্য হয়তো কখনোই উদঘাটন হবে না। কিন্তু সেই রাতের অভিজ্ঞতা তাদের জীবনকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছে, এই বিশ্বাস তার সর্বদা থাকবে। আর সেই রাতেই তারা
যেন প্রকৃতির এক নতুন রূপ দেখতে পেয়েছিল, যা হয়তো বইয়ে পাওয়া যায় না। গভীর
জঙ্গলের বুকে লুকিয়ে থাকা সেই শিক্ষা, ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তারা সর্বদা মনে রাখবে।
আরো গল্প পড়তে ভিজিট করুন: The World of Story