অন্ধকারের সঙ্গী

 অন্ধকারের সঙ্গী

বৃষ্টির ঝমাঝম শব্দ ছাপিয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেন আকাশের সব আলো কেউ শুষে নিয়েছে। কাঁচা রাস্তাটা পাথরের নুড়ি আর কাদায় মাখামাখি। প্রত্যেক পদক্ষেপে পা ডুবে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে মাটি যেন জীবন্ত হয়ে টেনে ধরছে। বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করার পর থেকেই এই অবস্থা। বাড়িটা বেশি দূরে নয়, কিন্তু এই এক কিলোমিটার পথ যেন ফুরোতেই চাইছে না।

বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ল। চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে আসছে। হাত দিয়ে যতবার মুছি, পরমুহূর্তেই আবার ঝাপসা হয়ে যায়। এই অবস্থায় সামনে এক হাত দূরের জিনিস দেখাও কঠিন। ভয় লাগছিল, ঠিকই। এই নির্জন রাস্তায়, এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে একা হাঁটা অভ্যাসের বাইরে। গ্রামের সবাই সাধারণত সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরে। এই অসময়ে আমি ফিরছি শুধু ঢাকাবাসী হওয়ারঅপরাধে’ – বাসের দেরি, ট্রেনের অনিশ্চয়তাকত কিছুই তো ঘটে।

হঠাৎ কাঁধের কাছে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। চমকে উঠলাম। এই ঘোর অন্ধকারে কে? পাশ ফিরতে না ফিরতেই একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। গভীর, পরিচিত সুর।

"কি হক ভাই, ঢাকা থেকে আসছেন? কেমন আছেন?"

থমকে দাঁড়ালাম। কণ্ঠটা খুব চেনা। কে হতে পারে এই রাতে? ঘোর অন্ধকারে মুখ দেখা সম্ভব নয়।

"কে? কে বলছেন?" প্রায় ফিসফিস করে বললাম। বৃষ্টির শব্দে হয়তো আমার কথা পৌঁছাল না।

আবার সেই কণ্ঠ, এবার একটু পরিষ্কার। যেন ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

"আরে, আমি গো! চিনতে পারছেন না? সেবার ঢাকা যাওয়ার আগে দেখা হয়েছিল... কী কাণ্ড!"

স্মৃতি হাতড়ালাম। কে হতে পারে? গলার স্বরে চেনা লাগছে, কিন্তু এই মুহূর্তে নামটা মনে পড়ছে না। গ্রামেই থাকি, টুকটাক দেখা সাক্ষাৎ হয় অনেকের সাথেই, কিন্তু এত পরিচিত কে যে এই ঝড় মাথায় করে আমার সাথে কথা বলছে?

"অন্ধকারে চিনতে পারছি না ভাই। কে আপনি?" বললাম আমি।

সে হেসে উঠল। সে হাসিটাও কেমন চাপা আর ভেজা ভেজা। বৃষ্টির কারণেই হয়তো এমন লাগছে।

"আরে বাবা, নাম বললে এক্ষুনি চিনবেন। কিন্তু এই অন্ধকারে নাম বলে লাভ কী? বলছেন কী, খুব ভয় পাচ্ছেন নাকি? এত অন্ধকারে একা..."

একথা শুনে একটু সাহস পেলাম। মনে হলো পরিচিত কেউ হয়তো আমাকে দেখে এগিয়ে এসেছে। বলল, "না, মানে একটু অসুবিধা হচ্ছে আর কি। রাস্তা দেখা..."

"আর বলতে হবে না। আমি আপনার সাথে যাই চলেন। এইটুকু পথ গল্প করতে করতে চলে যাব। ভয়ও করবে না।"

স্বস্তি পেলাম খানিকটা। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে সত্যিই একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। অন্ধকারে একা একা এই কর্দমাক্ত পথে হাঁটা বেশ অস্বস্তিকর।

"আরে বাহ! খুব ভালো হলো তাহলে। চলুন চলুন।" আমি তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলাম। অন্ধকারে তার অবয়বটা আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম মাত্র। লম্বা, রোগা ধরনের মনে হলো। পোশাকটা ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারলাম না। মনে হলো একটা চাদর গায়ে দিয়েছে এই দুর্যোগে।

আমরা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। সে আমার কুশল জানতে চাইল। ঢাকা থেকে আসা যাওয়ার পথে কী হয়, সেখানে জীবনযাত্রা কেমনএসব সাধারণ আলাপ। আমিও তার কথার উত্তর দিচ্ছিলাম। গ্রামের দু-চারজনের খোঁজ খবর নিলাম। সে স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল। মনে হচ্ছিল যেন বছরের পর বছর পর দেখা হওয়া দুই বন্ধুর আড্ডা।

তার হাঁটার গতি আমার চেয়ে একটু বেশি। আমাকে তাল মেলাতে হচ্ছিল। কিন্তু তার উপস্থিতিটা কেমন যেন শীতল লাগছিল। বৃষ্টির জন্য এমনিতেই ঠান্ডা, কিন্তু তার দিক থেকে একটা অস্বাভাবিক হিম এসে গায়ে লাগছিল। ভাবলাম হয়তো বেশি ভিজে গেছে তাই এমন লাগছে।

কথা বলতে বলতে আমরা কবরস্থানের কাছাকাছি চলে এলাম। গ্রামের একপাশে এই বিরাট কবরস্থানটা। দিনের বেলাতেও এদিকে কেউ বিশেষ দরকার ছাড়া আসে না। রাতের বেলা তো প্রশ্নই ওঠে না। কবরস্থানের পাশের রাস্তাটা পার হয়ে গেলেই আমার পাড়া শুরু। আর মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ।

হঠাৎ করেই লোকটা থেমে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালাম।

"কী হলো?" জিজ্ঞেস করলাম।

ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। ঠান্ডাটা যেন আরও তীব্র আকার ধারণ করল। এই কবরস্থানের পাশে এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমার মনে একটা বিদ্যুতের ঝলকের মতো কিছু খেলে গেল।

চমকে উঠলাম।

সে বলল, "আর একটু এগিয়ে গেলেই আপনার বাড়ি। আমি আর যাব না।"

সে আমার দিকে ফিরল। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু মনে হলো সে হাসছে। সেই ভেজা ভেজা চাপা হাসিটা আবার শুনতে পেলাম।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে... সেই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে একটা ভয়ংকর তথ্য বিস্ফোরিত হলো। যে লোকটার সাথে আমি এতক্ষণ কথা বলতে বলতে আসছিলাম, যার কণ্ঠস্বর এত পরিচিত মনে হচ্ছিল, যে আমার কুশল জানতে চাইছিল, যে আমাকে অন্ধকারে সঙ্গ দিচ্ছিল...

তার নামটা মনে পড়ে গেল।

শাহজাহান!

কথা বলতে বলতে যখন কবরস্থানের কাছে এসছি তখন হঠাৎ মনে পড়ল, “আরে! যার সাথে কথা বলছি, শাহজাহান... সেতো ১২ বছর আগেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে!”

আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। সারা শরীর অবশ হয়ে এল। হৃৎপিণ্ড পাগলের মতো লাফাচ্ছে বুকের ভেতর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি কি ভুল শুনছি? ভুল দেখছি? কিভাবে সম্ভব? শাহজাহান! সে তো মারা গেছে! সে কিভাবে আমার সাথে কথা বলছে? কিভাবে আমার পাশে পাশে হাঁটছে?

অন্ধকারে তার আবছা অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বৃষ্টি যেন থেমে গেছে হঠাৎ, অথবা আমার কান শুধু আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনছে না। কবরস্থানের পাশের ভেজা মাটি আর পচা পাতার গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে আসছে।

"কি হক ভাই, কী হলো? চুপ করে গেলেন কেন?" শাহজাহানের কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল। এবার কণ্ঠটা কেমন যেন ভারী, গভীর। মনে হলো কণ্ঠটা আসছে আমার ঠিক পাশ থেকে নয়, বরং মাটি ফুঁড়ে, কবরের ভেতর থেকে।

আমি এক পা পিছিয়ে গেলাম। আমার শরীর কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

"শা... শাহ... শাহজাহান!" কোনমতে উচ্চারণ করলাম। "তুমি... তুমি তো..."

সে আবার হাসল। এবার হাসিটা আর ভেজা ভেজা নয়। হাসি বীভৎস, শীতল। কবরস্থানের নিস্তব্ধতা ভেঙে সে হাসি যেন প্রতিধ্বনিত হলো।

"হ্যাঁ, আমি। চিনতে পারলেন এবার?" তার কণ্ঠস্বর নেমে এল ফিসফিসে। "বলেছিলাম না, নাম বললে চিনবেন। একটু দেরি হয়ে গেল চিনতে।"

আমার মনে পড়ল অ্যাক্সিডেন্টের কথা। ট্রাকের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। চেনা যাচ্ছিল না প্রায়। এই কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়েছিল। ১২ বছর! এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে।

"... এটা কিভাবে সম্ভব? তুমি তো মারা গেছো!" আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না ঠিকমতো।

"মারা গেছি?" সে কণ্ঠস্বরে অবাক হওয়ার ভান করল। "কে বলল মারা গেছি? আমি তো এখানেই আছি। আপনার সাথেই তো ছিলাম এতক্ষণ। ঢাকা থেকে ফিরছেন শুনে এগিয়ে এলাম। কতদিন পর আপনার সাথে দেখা। খুব ভালো লাগল।"

তার কথাগুলো স্বাভাবিক হলেও পরিবেশটা আর স্বাভাবিক ছিল না। কবরস্থানের ওপরের গাছপালাগুলো যেন অন্ধকারে আরও কালো, আরও ঘন হয়ে উঠল। বৃষ্টির শব্দ আবার কানে এল, কিন্তু এবার তা ঝমাঝম নয়, হিসহিস শব্দে যেন কিছু বলছে কানে কানে। ভেজা মাটির গন্ধের সাথে একটা পচা মিষ্টি গন্ধ মিশে গেল। কবরের পাথরগুলো অন্ধকারে যেন জ্বলজ্বল করছে।

"না... না... এটা সত্যি হতে পারে না।" আমি আরও পিছিয়ে যাচ্ছি। পায়ের তলায় কাদা, পিছলে যাওয়ার জোগাড়।

"আরে দাঁড়ান দাঁড়ান! যাচ্ছেন কোথায়?" শাহজাহান এবার আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল। অন্ধকারে তার আবছা অবয়বটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। দেখলাম, তার শরীর দিয়ে জল পড়ছে না, কিন্তু কেমন যেন ভিজে মনে হচ্ছে তাকে। পরনের কাপড়গুলো গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা দেখলাম... তার চোখ!

অন্ধকারেও তার চোখ দুটো জ্বলছে। ঠিকরে বের হচ্ছে একটা সবুজ আভা। সে চোখে কোন অনুভূতি নেই, শুধু শূন্যতা... আর ক্ষুধার্ত দৃষ্টি।

"কোথায় যাচ্ছেন? এত রাতে একা একা? কবরস্থানের এই পাশে অনেক বিপদ। তার চেয়ে চলুন না... ভেতরে যাই। আপনাকে কত কিছু দেখানোর আছে।" সে হাত বাড়ালো আমার দিকে। তার হাতটা যেন অন্ধকারে ঝুলে থাকা একটা ডাল। হাতটা লম্বা হচ্ছে, লম্বা হচ্ছে... আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

আমি চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। শরীরটা অবশ হয়ে গেছে ভয়ে। দৌড়াতে পারছি না।

শাহজাহান আরও এক পা এগিয়ে এল। আমি তার চোখের সবুজ আভাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সে হাসছে। তার মুখের হাঁটা যেন বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে... দাঁতগুলো অস্বাভাবিক রকমের সাদা।

"ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাবেন না। আমি আপনার ক্ষতি করব না। আপনি আমার বন্ধু।" সে ফিসফিস করে বলল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন আমার মাথার ভেতরে বাজছে।

"আসুন না হক ভাই, ভেতরে যাই। দেখবেন, কেমন শান্ত এখানে। মাটির নিচে বড় আরাম। কোন চিন্তা নেই, কোন ঝামেলা নেই। শুধু ঘুম... আর ঘুম..."

তার হাতটা আরও কাছে চলে এল। আমি টের পেলাম সেই হিম শীতল স্পর্শটা। শুধু তার গায়ে হাত দিলে যে ঠান্ডা লাগত প্রথমে, এখন তার উপস্থিতিটাই এই কবরস্থানের বাতাসকে জমাট করে দিয়েছে। একটা চাপা ঠান্ডা আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

আমার মনে হলো, যদি এই মুহূর্তে পালাতে না পারি, তাহলে আর কোনদিন পারব না। এই কবরস্থান আমাকে গিলে ফেলবে। শাহজাহান একা নয়, মাটির তলার আরও অনেকে যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তাদের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। ভেজা মাটির ভেতর থেকে যেন অসংখ্য হাত বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কবরের পাথরগুলো যেন নড়ছে।

সারা শরীরের সব শক্তি একত্র করে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। শাহজাহানকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দিলাম। কাঁচা রাস্তা ধরে নয়, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না, শুধু এই জায়গা থেকে পালাতে হবে। কবরস্থানের সীমানা থেকে দূরে, যত দূরে সম্ভব।

পিছন থেকে শাহজাহানের ডাক শুনতে পেলাম। এবার ডাকটা আর স্বাভাবিক নয়, বীভৎস আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে।

"দাঁড়ান! দাঁড়ান হক ভাই! যাচ্ছেন কোথায়? আমার সাথে চলুন! আমার সাথে থাকুন!"

তার কণ্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে না, বরং আমার পিছনে পিছনে আসছে। মনে হচ্ছে সে উড়ে আসছে। তার হাঁটার শব্দ নেই, শুধু একটা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে হিসহিস আওয়াজ আমার কানের কাছে বাজছে।

দৌড়াতে দৌড়াতে আমি রাস্তার কাদার মধ্যে আছড়ে পড়লাম। মুখ থুবড়ে পড়লাম নোংরা কাদায়। শরীরটা ব্যথা করছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে ব্যথার চেয়ে ভয়টা অনেক বেশি। আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।

উঠতে গিয়েই দেখলাম, আমার ঠিক সামনে শাহজাহান দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার চেয়েও দ্রুত। তার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মুখের চামড়া আলগা হয়ে গেছে, জল আর কাদা লেগে আছে। চোখ দুটো জ্বলছে সবুজ আভায়। তার মুখে সেই বীভৎস হাসি। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে।

"পারবেন না পালাতে। আমি তো এখানে আছি... সব জায়গায়। মাটির নিচে... বাতাসে... জলে..."

সে হাত বাড়ালো আমার দিকে। এবার তার হাতটা শুধু লম্বা নয়, হাতে নখগুলো বড় হয়ে গেছে, কালো আর ধারালো।

আমি চিৎকার করে উঠলাম। এবার গলা দিয়ে চিৎকার বের হলো। একটা তীব্র, অসহায় চিৎকার।

আমি পিছাতে লাগলাম। শাহজাহান এগিয়ে আসছে। তার শরীর থেকে পচা পাতার আর ভেজা মাটির গন্ধ আসছে তীব্রভাবে। মনে হচ্ছে সে নিজেই মাটি থেকে উঠে এসেছে।

"আপনার সঙ্গ আমার পছন্দ হয়েছে। কতদিন পর একজন কথা বলার লোক পেলাম। আর কোথাও যেতে হবে না আপনার। এখানেই থাকুন আমার সাথে। এই শান্তিতে..."

সে হাত বাড়ালো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মৃত্যুর শীতল স্পর্শ অনুভব করার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু স্পর্শটা এল না।

পরিবর্তে শুনলাম একটা তীব্র বিদ্যুতের শব্দ। কর্কশ, তীক্ষ্ণ। যেন আকাশ ছিঁড়ে যাচ্ছে।

চোখ খুলে দেখলাম, শাহজাহান থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের বীভৎস হাসিটা মিলিয়ে গেছে। চোখ দুটো বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। আকাশে একটা বিদ্যুতের ঝলক। সেই আলোয় দেখলাম, শাহজাহানের অবয়বটা কাঁপছে। ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

আর ঠিক তার পিছনেই, কবরস্থানের দিক থেকে, অসংখ্য ফিসফিসানি আর চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে অন্যেরা তাকে ডাকছে। মাটির তলা থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে।

বিদ্যুতের ঝলক আরও তীব্র হলো।

"না... না..." শাহজাহান আর্তনাদ করে উঠল। তার অবয়বটা আরও দ্রুত মিলিয়ে যেতে লাগল। বাতাস তাকে টেনে নিচ্ছে যেন। কবরস্থানের দিক থেকে আসা গোঙানিগুলো ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

"এখনো সময় আছে... ফিরুন! এখানেই আসুন!" গোঙানির মধ্যে শাহজাহানের কণ্ঠ মিলিয়ে গেল।

আমার দিকে বাড়ানো তার হাতটা ফ্যাকাশে হয়ে বাতাসে মিশে গেল। তার জ্বলন্ত চোখ দুটো নিভে গেল। শেষ বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখলাম, যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে শুধু ভেজা কাদা আর জল জমে আছে।

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালাম। শরীর কাঁপছে। চারিদিকে শুধু বৃষ্টি আর অন্ধকার। শাহজাহান নেই। সেই বীভৎস অবয়ব নেই। কিন্তু তার উপস্থিতি... মাটির তলার শীতল স্পর্শ... কবরের গন্ধ... সব যেন এখনো বাতাসে ভাসছে।

আর কবরস্থানের দিক থেকে ভেসে আসছে চাপা গোঙানি। মনে হচ্ছে তারা অসন্তুষ্ট। তাদের শিকার হাতছাড়া হয়েছে।

আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করলাম না। পেছন ফিরে তাকালাম না। জ্ঞান ফেরার আগেই যত দ্রুত সম্ভব বাড়ির দিকে ছুটলাম। কাদা মাটির পথ, বৃষ্টির শব্দ, অন্ধকারের ভয়... কিছুই আমার গতিরোধ করতে পারল না। শুধু দৌড়েছি। একটানা। যতক্ষণ না বাড়ির আলো চোখে পড়েছে, ততক্ষণ থামা কি জিনিস, ভুলে গিয়েছিলাম।

বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। ভেতরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। আমি দরজায় কড়া নাড়লাম। আমার ভেজা শরীর, কাদায় মাখামাখি অবস্থা দেখে বাড়ির লোকজন চমকে গেল।

কিন্তু তাদের মুখে আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু কাঁপতে লাগলাম। সেই রাত... শাহজাহানের আহ্বান... কবরস্থানের গোঙানি... সবুজ জ্বলন্ত চোখ... সবকিছু আমার চোখের সামনে ভাসছে।

জানি, সে রাতে আমি শুধু শাহজাহানকে দেখিনি। দেখেছি মাটির তলার অন্য জগৎটাকে। আর জেনে গেছি, কিছু রাস্তা দিনের বেলাতেও একা হাঁটা উচিত নয়। আর রাতের বেলা? বিশেষ করে বর্ষার রাতে... যখন অন্ধকার আর বৃষ্টি সবকিছুকে ঢেকে দেয়... তখন মাটির তলার বাসিন্দারা জেগে ওঠে। আর তারা সঙ্গ চায়। চিরকাল...

সেই রাতের পর আমি আর কোনদিন একা রাতে সে রাস্তা দিয়ে যাইনি। দিনের বেলায়ও কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। মনে হয়, অসংখ্য চোখ আমাকে দেখছে। মাটির তলা থেকে... অপেক্ষা করছে। হয়তো আবার কোন বর্ষার রাতে... নিকষ অন্ধকারে... আমার জন্য... অথবা অন্য কারো জন্য...

সকল গল্প পড়তে ক্লিক করুন: The World of Story

 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Ad

Ad