শীষনগর জমিদার বাড়ির রহস্য: এক ভয়াল কিংবদন্তি
শীষনগর জমিদার বাড়ির রহস্য: এক ভয়াল কিংবদন্তি
অনেক অনেক
বছর আগের কথা। সময়টা ঠিক কবেকার, তা যেন ধুলোমাখা
ইতিহাসের পাতাতেও স্পষ্ট লেখা নেই। শুধু মানুষ মুখে মুখে ফেরে এক গা ছমছমে
কিংবদন্তি। কিংবদন্তি সেই সময়ের যখন শীষনগর গ্রাম ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ, আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিল শীষনগর জমিদার বাড়ি।
কেবল ইটে পাথরে গড়া এক বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা নয়, এ যেন ছিল এক জীবন্ত সত্তা। শত শত বছর ধরে জমিদার বংশের
পদচারণায়,
দাস-দাসীদের কোলাহলে, উৎসব-পার্বণে, হাসিকান্নায় মুখরিত
থাকত এই বাড়ি। ভোরের আলো ফুটত পূজার শঙ্খধ্বনিতে, দিনের শেষে ক্লান্ত সূর্য অস্ত যেত সান্ধ্য আরতির প্রদীপ শিখায়। উঠোনে শিশুদের
দুরন্তপনা, বৈঠকখানায় জমিদার মশাইয়ের গম্ভীর
আলোচনা,
অন্দরমহলে নারীদের খিলখিল হাসি—সব মিলিয়ে বাড়িটা যেন ছিল প্রাণোচ্ছলতার
প্রতিশব্দ।
কিন্তু সে
যেন অন্য জীবন, অন্য জগৎ। একদিন সব পাল্টে গেল। হঠাৎ
করেই,
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, শীষনগর জমিদার বাড়ির আকাশ থেকে সূর্য ডুবে গেল চিরদিনের জন্য। সেদিন কী হয়েছিল, কেউ জানে না। শুধু এটুকু জানা যায়, একদিন সকালে ঘুম ভেঙে গ্রামবাসী দেখেছিল, জমিদার বাড়ির ফটক খোলা, কিন্তু ভেতরে কোনো প্রাণের সাড়াশব্দ নেই। বিশাল বাড়িটা যেন রাতারাতি গিলে
খেয়েছে তার সমস্ত বাসিন্দাদের। জমিদার মশাই, মহীয়সী জমিদার গিন্নি, তাদের
সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনি, দাস-দাসী, পাহারাদার—যেন স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেছে সকলে।
গ্রামবাসী
ছুটে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রতিটা ঘরে খুঁজে দেখেছিল তারা, প্রতিটা আনাচে কানাচে। কিন্তু না, কেউ কোথাও ছিল না। যেন স্রেফ একটা স্বপ্ন ছিল এতদিনের
জীবনযাত্রা, আর ঘুম ভাঙতেই সব শেষ। জিনিসপত্র
এলোমেলো ছিল না, লুটপাটের কোনো চিহ্ন ছিল না।
রান্নাঘরে আধপোড়া কাঠ, উঠোনে শিশুদের ফেলে
রাখা খেলা, বৈঠকখানায় খোলা বই—সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বাড়ির মানুষ হঠাৎ করে উঠে কোথাও চলে গেছে। কিন্তু 'কোথাও' বলতে তো কিছু ছিল
না। গ্রাম ছেড়ে জমিদার পরিবারের কেউ কোথাও যায়নি, অন্তত কেউ তাদের যেতে দেখেনি। আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাদের কোনো চিহ্ন
মেলেনি। তারা যেন স্রেফ হাওয়া হয়ে গিয়েছিল বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর থেকেই।
এই রহস্যময়
অন্তর্ধানের পর থেকেই শীষনগর জমিদার বাড়িটা আর আগের মতো থাকেনি। জীবিত মানুষের
পদচারণা বন্ধ হয়ে গেল সেখানে। গ্রামের মানুষ বাড়িটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। দিনের
বেলায় বিশাল বাড়িটার দিকে তাকালে কেমন যেন এক শূন্যতা আর বিষণ্ণতা ঘিরে ধরত। আর
রাতের বেলা? রাতের বেলা বাড়ির আশেপাশে যাওয়া তো
দূরের কথা, সেদিকে তাকাতেও ভয় লাগত। লোকমুখে
ছড়াতে লাগল নানা কথা। কেউ বলত, পরিবারের সবাইকে
মেরে বাড়ির ভেতরেই কোথাও পুঁতে ফেলা হয়েছে। হয়তো গোপন কোনো কুঠুরিতে, অথবা বাড়ির পেছনের পুকুরে। আর তাদের অতৃপ্ত আত্মারা নাকি
আজও ঘুরে বেড়ায় বাড়ির ভেতরে, মুক্তি খুঁজে ফেরে।
এই ধারণাকে
আরও শক্তিশালী করে তুলল বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত সব শব্দ। বিশেষ করে রাতের
গভীরে,
অথবা গোধূলি লগ্নে, যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন শীষনগর জমিদার
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসত চাপা কান্নার শব্দ। সে কান্না নাকি মানুষের কান্নার মতো, কিন্তু আরও ভয়াবহ, আরও মর্মান্তিক। মনে হতো যেন শত শত আত্মা একসঙ্গে আর্তনাদ করছে। কেউ কেউ ভয়ে
ভয়ে একটু কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সেই কান্নার
শব্দ শুনে আতঙ্কে দৌড়ে পালিয়েছে। সেই কান্নার শব্দ নাকি কখনো কখনো অস্পষ্ট
ফিসফিসানির মতো শোনায়, কখনো বা চিৎকার হয়ে
ওঠে,
যেন কেউ সাহায্য চাইছে।
গ্রামের
প্রবীণরা বলতে শুরু করল, বাড়িটার ওপর অভিশাপ
লেগেছে। হয়তো জমিদার বংশের কেউ কোনো বড় পাপ করেছিল, যার ফল ভোগ করতে হয়েছে সবাইকে। অথবা বাড়ির মাটিতে এমন কিছু ছিল, যা স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক। সময়ের সাথে সাথে বাড়িটা পরিত্যক্ত হতে হতে আরও ভুতুড়ে হয়ে উঠল।
লতাপাতা গ্রাস করল দেয়াল, ধুলো আর মাকড়সার
জালে ঢেকে গেল আসবাবপত্র। তবুও, রাতের গভীরে সেই
কান্নার শব্দ থেমে থাকেনি।
এই রহস্যের
টানে,
অথবা হয়তো দুঃসাহসিকতার বশে, দু-একজন মানুষ চেষ্টা করেছিল জমিদার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সত্যটা জানার।
তারা ছিল এলাকারই লোক, যারা যুক্তিতর্কে
বিশ্বাসী ছিল, অলৌকিক বিষয়কে পাত্তা দিত না। তারা
ভেবেছিল,
হয়তো রহস্যের পেছনে কোনো সাধারণ কারণ আছে, যা এতদিন অজানা রয়ে গেছে। হয়তো বাড়ির ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে, অথবা কোনো চোরাকুঠুরি আছে যেখানে সবাই আশ্রয় নিয়েছিল।
কিন্তু যারা ভেতরে প্রবেশ করেছিল, তারা আর কখনো ফিরে
আসেনি। না তাদের লাশ পাওয়া গেছে, না তাদের কোনো
চিহ্ন। তারাও যেন জমিদার পরিবারের মতোই বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে
গিয়েছিল। এই ঘটনাগুলোর পর গ্রামের মানুষের ভয় আরও বেড়ে গেল। শীষনগর জমিদার বাড়ি
হয়ে উঠল এক নিষিদ্ধ স্থান, মৃত্যুরফাঁদ।
বহু বছর
কেটে গেছে। সময় গড়িয়েছে, পুরনো প্রজন্ম
বিদায় নিয়েছে, এসেছে নতুন প্রজন্ম। কিন্তু শীষনগর
জমিদার বাড়ির কিংবদন্তি রয়ে গেছে একই রকম। কান্নার শব্দ, রহস্যময় অন্তর্ধান, ফিরে না আসার গল্পগুলো গ্রামের লোককথা আর রাতের আড্ডার গা ছমছমে বিষয় হয়ে
দাঁড়িয়েছে। আধুনিক যুগেও কেউ সাহস করে দিনের বেলাতেও বাড়ির কাছে ঘেষত না।
ঠিক এই সময়ে, চার বন্ধুর একটি দল রহস্য উদঘাটনের নেশায় মেতে উঠল। আরমান, রিনা, কবির আর দীপা। তারা
শহরের ছেলেমেয়ে, পড়াশোনা করছে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে, কিন্তু সবারই আগ্রহ প্যারানরমাল বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে। শীষনগর
জমিদার বাড়ির গল্প তাদের কানে পৌঁছায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে, কিছু পুরনো স্থানীয় লোককথা সংগ্রহকারীর ব্লগ পড়ে। প্রথমটায়
তারা এটাকে স্রেফ গল্পগাথা ভেবেছিল, কিন্তু যত গভীরে যায়, ততই যেন টান অনুভব
করে। বিশেষ করে আগের রহস্যভেদী দলগুলোর ফিরে না আসাটা তাদের কৌতূহলকে উসকে দেয়।
এটা কি স্রেফ দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে
সত্যিই কোনো অস্বাভাবিক কিছু আছে?
অনেক
আলোচনার পর, তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা শীষনগর
যাবে। গ্রামবাসীর সমস্ত নিষেধ, সমস্ত ভয় উপেক্ষা
করে তারা এই রহস্যের কিনারা করবেই। আরমান, দলনেতা, কিছুটা যুক্তিবাদী, সবকিছুর একটা ব্যাখ্যা খোঁজে। রিনা, দলের সবচেয়ে সংবেদনশীল সদস্য, সূক্ষ্ম শক্তি আর অনুভূতির প্রতি তার সহজাত প্রবণতা আছে। কবির, টেকনিক্যাল দিকগুলো দেখে, ক্যামেরা, রেকর্ডার, ইএমএফ মিটার (তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র পরিমাপক যন্ত্র) তার
দায়িত্ব। আর দীপা, কিছুটা রোমান্টিক
প্রকৃতির,
কিন্তু দৃঢ়চেতা, গল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আগ্রহী।
গ্রামে
পৌঁছে তারা প্রথমেই গ্রামের প্রবীণদের সাথে কথা বলল। বৃদ্ধরা তাদের শত হাতে বারণ
করল। জমিদার বাড়ির গল্প বলতে গিয়ে তাদের চোখমুখে ফুটে উঠল গাঢ় ভয়। তারা বলল, "ওখানে যেও না তোমরা। ও বাড়ি জীবিত মানুষের জন্য নয়। ও বাড়ি
আত্মা আর অন্ধকারের।" একজন বৃদ্ধ তো বলেই বসলেন, "ভেতরে যারা গেছে, তারা আর মানুষের জগতে নেই। তারা হয়তো এখনও বাড়ির ভেতরেই আছে, অন্য রূপে।"
কিন্তু
শহরের আধুনিক ছেলেমেয়েদের কাছে এই কথাগুলো কুসংস্কার বলেই মনে হলো। তারা ভাবল, হয়তো পুরনো দিনে কোনো খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছিল, যা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, আর সেই কারণেই লাশগুলো পাওয়া যায়নি। আর কান্নার শব্দ হয়তো বাতাসের খেলা, অথবা বাড়ির কাঠামোর পুরনো শব্দের প্রতিধ্বনি।
পরের দিন
ভরদুপুরে,
যখন সূর্য মাথার উপর, ভয় কিছুটা কম থাকে, তখন তারা জমিদার
বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে তারা দেখল বিশাল বাড়িটা
দাঁড়িয়ে আছে এক ভৌতিক নীরবতা নিয়ে। চারপাশের জঙ্গল আর লতাপাতা বাড়িটাকে প্রায়
গ্রাস করে ফেলেছে। ফটক দুটো মরচে ধরে জীর্ণ হয়ে আছে, দেখে মনে হয় বহু বছর কেউ খোলেনি বা বন্ধ করেনি।
তাদের প্রথম
পদক্ষেপ যখন বাড়ির সীমানায় পড়ল, তখনই রিনা শিউরে
উঠল। তার মনে হলো যেন হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেশ কিছুটা নিচে নেমে গেছে। বাতাস ভারী
হয়ে গেছে আর কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ আসছে – পুরনো ধুলো আর বদ্ধ হাওয়ার সাথে
মিশে আছে মিষ্টি মিষ্টি কীসের যেন গন্ধ, কেমন বমি ভাব আসে। কবির ইএমএফ মিটার অন করল, কিন্তু প্রাথমিক রিডিং স্বাভাবিক ছিল।
আরমান হেসে বলল, "দেখলে? সব মনের ভয়।"
ভেতরে
ঢুকতেই বিশাল উঠোন। আগাছায় ভর্তি। ডানদিকে কাছারি ঘর, বামদিকে আস্তাবল আর অন্যান্য ঘর। সামনে মূল অট্টালিকা। বারান্দায় উঠে তারা মূল দরজা ঠেলল। দরজাটা
ক্যাঁচ করে একটা বীভৎস শব্দ করে খুলে গেল, যেন দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে বাড়িটা চিৎকার করে উঠল। ভেতরে ঢুকতেই সূর্যের আলো এসে
পড়ল বিশাল হলঘরে। চারদিকে শুধু ধুলো আর ধ্বংসের চিহ্ন। দামি আসবাবপত্র সব ধুলোর
আস্তরণে ঢাকা, কোথাও মাকড়সার জাল, কোথাও দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়েছে।
তারা ধীরে
ধীরে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রতিটা পদক্ষেপ যেন এক অজানার দিকে। তাদের টর্চের আলোয়
ঘরগুলোর ভেতরটা আলোকিত হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সে আলো যেন অন্ধকারের বিশালতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। প্রথমে সব শান্ত
ছিল,
শুধু তাদের নিজেদের পায়ের শব্দ আর ভাঙা কাঁচের টুকরোর মটমট
আওয়াজ।
তারা ঘুরে
দেখতে লাগল ঘরগুলো। বৈঠকখানা, পাঠাগার, খাওয়াদাওয়া ঘর... সর্বত্রই একই দৃশ্য – পরিত্যক্ত, জীর্ণ, কিন্তু এককালের
সমৃদ্ধির চিহ্ন বিদ্যমান। হঠাৎ রিনা থেমে গেল। "তোমরা শুনতে পাচ্ছ?" সে ফিসফিস করে বলল। সবাই কান খাড়া করল। প্রথমে কিছু না, তারপর খুব ক্ষীণ, প্রায় শোনা যায় না এমন একটা আওয়াজ। হ্যাঁ, কান্নার শব্দ। চাপা, গোঙানির মতো। মনে
হচ্ছে যেন খুব দূর থেকে আসছে, অথবা বাড়ির অনেক
গভীর থেকে।
আরমান বলল, "হাওয়া হয়তো। পুরনো বাড়িতে এরকম হয়।" কিন্তু রিনার মুখ
ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। দীপা আর কবিরের মুখও গম্ভীর। তারা তাদের রেকর্ডার চালু করল।
তারা উপরের
তলায় উঠল। সিঁড়িগুলো শব্দ করছে। উপরের ঘরগুলোও একই রকম—বিলাসবহুল শয়নকক্ষ, শিশুদের খেলার ঘর, পূজার ঘর। শিশুদের খেলার ঘরে একটা ভাঙা পুতুল পড়ে আছে, একটা ছোট কাঠের ঘোড়া উল্টে আছে। দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
এই ঘরগুলোতেই তো একদিন শিশুরা হেসে খেলে বেড়াত।
কান্নার
শব্দটা যেন ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। মনে হচ্ছে উপরের ঘর থেকেই আসছে। তারা শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে
শব্দটা খুব স্পষ্ট হলো। ছোট শিশুদের কান্নার মতো শোনাচ্ছে। দীপার বুক কেঁপে উঠল।
আরমান দরজাটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ভেতর থেকে
বন্ধ। দীপা বলল, "ভেতরে কেউ আছে?"
কবির তার
যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা করল। ইএমএফ মিটার হঠাৎ তীব্রভাবে কেঁপে উঠল। এটার মানে
এখানে খুব শক্তিশালী কোনো শক্তি কাজ করছে। আরমান আর অবিশ্বাস করতে পারল না। ভেতরে
আসলেই কিছু একটা আছে।
তারা দরজা
ভাঙার চেষ্টা করল। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর দরজাটা ভেঙে খুলে গেল। ঘরটা ছিল একটা
ছোট্ট গুদামঘর বা স্টোররুমের মতো। ভেতরে আবছা আলো-আঁধারি। কিন্তু ঘরটা খালি! কোনো
মানুষ নেই, কিছুই নড়াচড়া করছে না। অথচ কান্নার
শব্দটা এখনও কানে আসছে, কিন্তু এখন মনে
হচ্ছে যেন ঘরের দেওয়াল ভেদ করে আসছে, অথবা তাদের নিজেদের মাথার ভেতর থেকে!
হঠাৎ ঘরের
কোণে কিছু একটা নড়ল! প্রথমে তারা ভাবল হয়তো ইঁদুর বা অন্য কোনো প্রাণী। কিন্তু আলো
ফেলতেই তারা যা দেখল, তাতে তাদের
হৃৎপিণ্ড যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। আবছা ছায়ার মতো কিছু অবয়ব। ছোট ছোট, বাচ্চাদের মতো। তারা ফিসফিস করে কাঁদছে। তাদের আকৃতি স্পষ্ট
নয়,
কিন্তু তাদের উপস্থিতি স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে। একটা তীব্র, ঠান্ডা স্রোত যেন তাদের শরীর ভেদ করে গেল।
রিনা
আর্তনাদ করে উঠল। "ওরা এখানে আছে! ওরা বাড়ির ভেতরেই আছে!"
ছায়া
অবয়বগুলো নড়াচড়া করতে শুরু করল।
কান্নার শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঘরটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। আসবাবপত্র নড়তে
শুরু করল। বাতাসের গতিবেগ বাড়ল ঘরের ভেতরেই, অথচ বাইরে কোনও বাতাস নেই।
কবির তার
ক্যামেরা অন করল। কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ছবি ঝাপসা হয়ে আসছিল। ইএমএফ মিটার পাগলের মতো রিডিং দিতে শুরু করেছে।
হঠাৎ একটা
ছায়া দীপার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সেটা দেখতে ছোট মেয়ের মতো, কিন্তু তার মুখটা বিকৃত আর চোখে তীব্র যন্ত্রণা। দীপা ভয়ে পিছিয়ে
গেল। ছায়াটা তার দিকে হাত বাড়াল। সেই হাত যেন স্রেফ ধোঁয়াশার তৈরি, কিন্তু তার ছোঁয়া বরফের মতো ঠান্ডা আর যন্ত্রণাদায়ক।
আরমান দীপার
হাত ধরে টানল। "পালাও!"
তারা দৌড়ে
ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেল, কিন্তু দরজাটা
সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তাদের সামনে। তারা আটকা পড়ে গেছে!
চারিদিকে
কান্নার আওয়াজ, ফিসফিসানি, আর অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। অন্ধকারে ছায়া অবয়বগুলো তাদের
দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, কেন আগের লোকেরা ফিরে আসেনি। এই বাড়ি তাদের মুক্তি দেয় না। যারা এর রহস্য
জানতে আসে, তারাও এর অংশ হয়ে যায়।
আরমান, রিনা, কবির আর দীপা
প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল। তাদের টর্চের আলো ছায়ার মতো অবয়বগুলোর ওপর
পড়ছিল,
কিন্তু তাদের সরাতে পারছিল না। দেওয়াল থেকে বীভৎস মুখ উঁকি
দিতে লাগল, মেঝে থেকে উঠে আসতে চাইল ঠান্ডা হাত।
সেই মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা এখন বমির উদ্রেক করছিল, যেন মৃত্যুর গন্ধ।
তাদের
চিৎকার বাড়ির নীরবতার ভেতরেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, সময়ের থাবার নিচে চাপা পড়া এই জমিদার বাড়ি তাদের গ্রাস করতে
প্রস্তুত হচ্ছিল, ঠিক যেমন গ্রাস
করেছিল তার পূর্বের বাসিন্দাদের আর রহস্য সন্ধানীদের।
তাদের
ক্যামেরা হয়তো তখনও চলছিল, রেকর্ডার হয়তো তখনও
শব্দ ধারণ করছিল – সেই মর্মান্তিক কান্নার শব্দ, যা বহু বছর ধরে শীষনগর জমিদার বাড়ির নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে চলেছে। কিন্তু সেগুলোর
খোঁজ নেওয়ার জন্য আর কেউ হয়তো কোনোদিন সাহস করে ওই বাড়ির গভীরে প্রবেশ করবে না।
সন্ধ্যা
নেমে এলো। গ্রামের মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে দেখল বিশাল বাড়িটার ওপর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।
আর একটু পরেই, নির্দিষ্ট সময়ে, চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসবে সেই পরিচিত, গা ছমছমে কান্নার শব্দ। সে কান্না যেন বলে যায়, শীষনগর জমিদার বাড়ির রহস্য আজও অমীমাংসিত। আর যারা এর গভীরে
প্রবেশ করেছে, তারা চিরকালের জন্য সেই কান্নার অংশ
হয়ে গেছে। বাড়িটা দাঁড়িয়ে রইল তার সমস্ত অন্ধকার রহস্য আর অতৃপ্ত আত্মাগুলোকে নিয়ে, অপেক্ষায় রইল পরবর্তী শিকারের জন্য। হয়তো সেই কান্নার
শব্দের সাথে মিশে গেছে আরও কয়েকটি নতুন আত্মা, যারা আরমান, রিনা, কবির আর দীপা নামে পরিচিত ছিল একসময়।
আরো গল্প পড়তে ভিজিট করুন: The World of Stories